ধান কাটার উদ্বোধন করছেন মাগুরা জেলা প্রশাসক। ছবি: এস আর এ হান্নান
মাগুরা: সবকিছু দিয়েছে কৃষি বিভাগ, ধান নিয়েছেন কৃষক। এ যেনো লাভের ওপরেও লাভ। তাইতো কৃষকের মুখে দেখা গেছে হাসির ঝিলিক। বীজ, সার, মেশিনের মাধ্যমে ট্রে’তে বীজ ফেলা, তা থেকে চারা তৈরি, মেশিনের মাধ্যমে চারা রোপণ, ধানের ক্ষেতের খোঁজ খবর নেওয়া। ধান পাঁকার পর মেশিনেই কর্তন, মাড়াই এবং ঝাড়া পর্যন্ত সব পর্যায়ের খরচ বহন করেছে কৃষি বিভাগ। কৃষক শুধু চকচকে, ঝরঝরে সোনালী ধান বস্তা ভরে বাড়িতে নিয়ে গেছেন। আর খড়ের দাম-দর ও লাভের হিসেব তো বাদই থাকলো।
মাগুরার মহম্মদপুরে প্রথমবারের মতো সমলয় পদ্ধতির ধান চাষে শত কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের পিয়াদাপাড়া হরিণধরার মাঠে একশ’ কৃষক দেড়শ’ বিঘা জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে হাইব্রিড ধান সিনজেনটা-১২০৩ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে সাফল্য পেয়েছেন। প্রথমবারের মতো এ পদ্ধতিতে ধান চাষে তুলণামূলক কম খরচে ভালো ফলন পেয়ে লাভবান হওয়ায় এসব কৃষক খুবই খুশি।
গত সোমবার (৮ মে) সকালে এ মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে ধান কর্তনের শুভ সূচনা করেন মাগুরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবু নাসের বেগ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক সুফি মো. রফিকুজ্জামান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রামানন্দ পাল, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বরকত আলী, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মোছা: বেবী নাজনীন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) বাসুদেব কুমার মালো, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সোবাহান, বিনোদপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিকদার মিজানুর রহমানসহ জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, সূধি মন্ডলী ও স্থানীয় কৃষক। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কম্বাইন হার্ভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে পুরো মাঠের দেড়শ’ বিঘার জমির পাঁকা ধান কর্তন, মাড়াই ও ঝাড়াই শেষ করে নতুন ধান ঘরে তোলেন কৃষক।
সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, বিশেষ অটোমেটিক কৃষি যন্ত্রের (সিডার) মাধ্যমে প্লাস্টিকের ট্রে’তে বীজ বপন করা হয়। ট্রে’তে বীজ বপন যন্ত্রের ৩টি চেম্বার থাকে। প্রথম চেম্বারে মাটি দেওয়া হয়। মেশিনের মাধ্যমে মাটি সরাসরি ট্রে’তে পড়ে। দ্বিতীয় চেম্বারে দেওয়া হয় অঙ্কুরিত বীজ। সেই বীজও মেশিনের মাধ্যমে সঠিক পরিমাণে ট্রে’তে গিয়ে পড়ে। তৃতীয় চেম্বারে আবারো মাটি দেওয়া হয়। সেই মাটিও মেশিনের মাধ্যমে বীজসহ ট্রে’তে পড়ে এবং মাটিতে বীজ ঢেঁকে দেয়। একটি মাঠে বা মাঠের বড় একটি অংশের সকল কৃষক সবাই মিলে একসাথে একই সময়ে সিডার মেশিনের মাধ্যমে ট্রে’তে বীজ থেকে একই জাতের ধানের চারা (পাতো) তৈরি, একই সময়ে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনের মাধ্যমে ধানের চারা রোপণ এবং ধান পাঁকার পর কম্বাইন হার্ভেস্টার মেশিনের মাধ্যমে একই সময়ে কর্তনের এই প্রক্রিয়াকে ‘সমলয় পদ্ধতি’ বলা হয়। এ পদ্ধতিতে যন্ত্রের ব্যাবহার বেশি হয়ে থাকে। ফলে কৃষকের খরচ কম।
প্রাচীণ ও প্রচলিত পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি নয়, উপজেলার একশ’ কৃষক প্লাস্টিকের ট্রে’তে চারা তৈরি করেন। ২০ থেকে ২৫ দিরে মধ্যেই চারা রোপণের উপযোগী হয়। চারা রোপণের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা। গতানুগতিক পুরোনো পদ্ধতি নয়, এসব কৃষক চারা রোপণ করেন রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনের মাধ্যমে। মূলত: এটিই হচ্ছে সমলয় পদ্ধতির একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া।
সূত্র জানায়, কৃষি প্রণোদনার আওতায় স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের পিয়াদাপাড়া হরিণধরার মাঠে একশ’ কৃষকের দেড়শ’ বিঘা জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য বিনামূল্যে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড ধান সিনজেনটা-১২০৩ জাতের বীজ ও সার দেওয়া হয়। এরপর তারা একসাথে ট্রে’তে চারা তৈরি করেন। চারা লাগানোর উপযোগী হলে এসব কৃষক রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনের মাধ্যমে একযোগে চারা রোপণ করেন। হাইব্রিড ধান সিনজেনটা-১২০৩ জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে এসকল কৃষকর নিবিড় যতœ ও পরিচর্যা করেন। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্লকের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সমলয় পদ্ধতির দিগন্ত বিস্তৃত দেড়শ’ বিঘা জমি রোপণকৃত এই ধানের মাঠে নিয়মিত পরিদর্শণ ও সার্বিক তদারকী করেন।
ধান চাষে কৃষকদের শ্রমিক সঙ্কট নিরসন, সময়-শ্রম এবং অতিরিক্ত খরচ কমাতে সমলয় পদ্ধতির এই ধান চাষে কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যাবহারে লাভবান হয়েছেন কৃষক। কৃষিতে খুলেছে নতুন দুয়ার। বাম্পার ফলন হওয়ায় বিঘা প্রতি কৃষক ধান পেয়েছেন ৩১ মণ।
উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের পিয়াদাপাড়া এলাকার বাসিন্দা ও সমলয়ভূক্ত মাঠের কৃষক আবু হাসান বলেন, ‘এবারই প্রথম এভাবে ধান চাষ করেছি। ভালো ফলন হয়েছে। সবকিছু করেছে কৃষি অফিসের স্যারেরা। আমরা সবাই ধান নিয়ে গেছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুস সোবাহান বলেন, ‘সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যাবহারের ফলে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ায় কৃষকরা বেশি লাভবান হন। চলতি মৌসুমে বীজ, সার থেকে শুরু করে ধান উৎপাদনে সবকিছু দিয়েছি আমরা। কৃষক হাসিমুখে ধান নিয়ে গেছেন বাড়িতে।’