অভিযোগকারী মাইনুল ইসলাম শাওন(বামে) ও রাঙ্গাবালীর সাবেক ইউএনও মাশফাকুর রহমান
পটুয়াখালী: পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ঠিকাদার মাইনুল ইসলাম শাওন। ঠিকাদারির আড়ালে জালিয়াতি ও প্রতারণা করাই যার পেশা। সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাশফাকুর রহমানের বিরুদ্ধে করা শাওনের সব অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত কমিটির কাছে ধরা পড়েছে তার সব জালিয়াতি।
অভিযোগের তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে সম্প্রতি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উভয়পক্ষের বক্তব্য, উপস্থাপিত প্রমাণক এবং নথিপত্র পযালোচনায় তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয় যে, অভিযোগকারী মাইনুল ইসলাম শাওন তার অভিযোগে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করেছেন। রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে উপস্থাপিত অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণক, সাক্ষী বা কোনো তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। সুতরাং রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা।
পটুয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর ও জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অভিযোগকারী মাইনুল ইসলাম শাওন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের চাহিদা অনুযায়ী মুজিব শতবর্ষের ১ম, ২য় ও ৩য় পর্যায়ের বেশ কিছু ঘরের মালামাল ও শ্রমিক সরবরাহ করেন। প্রথম পর্যায়ে মালামাল সরবরাহের সময় উপজেলা নির্বাহী অফিসার চুক্তিপত্র লেখার জন্য অভিযোগকারীর কাছ থেকে তার সাক্ষরিত সম্বলিত অলিখিত একশত টাকার তিনটি স্ট্যাম্প নেন। যা পরবর্তীতে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঠিকাদার মাইনুল ইসলাম শাওনকে ফেরত দেননি বলে অভিযোগ।
শাওনের এ অভিযোগের বিষয়ে রাঙ্গাবালীর ইউএনও তদন্ত কমিটিকে জানান, অভিযোগপত্রে বর্ণিত অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের গৃহনির্মাণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য ক্রয় কমিটির সব সদস্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাইনুল ইসলাম শাওনকে গৃহনির্মাণের মালামাল ও শ্রমিক সরবরাহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। চুক্তিপত্রের প্রয়োজন হলে তা ক্রয় কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হতো। অথচ মাইনুল ইসলাম শাওন অন্য সদস্যদের না জানিয়ে, এমনকী স্ট্যাম্প দেওয়ার কোনো প্রমাণক সংরক্ষণ না করে কেবল তার স্বাক্ষর সম্বলিত অলিখিত স্ট্যাম্প চুক্তিপত্রের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা রাখবেন বিষয়টি অযৌক্তিক এবং সাজানো তিনি মনে করেন। স্ট্যাম্প দেওয়ার দিন, তারিখ কিংবা সাক্ষীর নাম উল্লেখ না করে এমন অভিযোগ কেবলমাত্র ইউএনওকে হয়রানি করার জন্যই করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি বলছে, অভিযোগকারী শুনানিতে তদন্ত কমিটির কাছে তার অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণক, সাক্ষী বা তার স্বাক্ষর সম্বলিত অলিখিত স্ট্যাম্প রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে হস্তান্তরের কোনো প্রাপ্তি স্বীকারপত্র উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে অভিযোগটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি।
অভিযোগ খ-গ: অভিযোগকারী জামানত হিসেবে মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ (তার মায়ের নামে পরিচালনাধীন) রুপালী ব্যাংক, বাহেরচর শাখার কাছে অলিখিত চেক (যার হিসাব নম্বর ৩৪৯১০২০০০০৫৯৯ ও চেক নং ৪৯৯৯৯৬৫) উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা রাখেন। পরে ইউএনওর কাছে চেকের পাতাটি ফেরত চাইলে চেকটি খুঁজে পাচ্ছেন না বলে শাওনকে জানান ও বাসা থেকে বাজারে যাওয়ার পথে চেকের পাতাটি হারিয়ে গেছে বলে থানায় জিডি করতে বলেন। ইউএনওর কথা অনুযায়ী শাওন থানায় জিডি করেন। এ সময় ইউএনওর আচরণ অভিযোগকারীর কাছে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তিনি জিডির কপি ব্যাংকের ওই শাখায় জমা দেন। তিনি ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে জানতে পারেন, যার পরিচালনায় একাউন্ট পরিচালিত হচ্ছে তাকে অর্থাৎ তার মাকে জিডি করতে হবে। এরপর অভিযোগকারী তার মাকে দিয়ে আরও একটি জিডি করান।
এ অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও কমিটিকে জানান, অভিযোগপত্রে বর্ণিত জামানত হিসেবে মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ (তার মায়ের নামে পরিচালনাধীন) রুপালী ব্যাংক, বাহেরচর শাখার কাছে অলিখিত চেক (যার হিসাব নম্বর ৩৪৯১০২০০০০৫৯৯ ও চেক নং ৪৯৯৯৯৬৫) তার কাছে জমা রাখা এবং চেক হারিয়ে গেছে বলে থানায় জিডি করার পরামর্শ দেওয়ার অভিযোগটি সম্পূর্ণ অমূলক, মনগড়া ও সাজানো।
তিনি আরও জানান, ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক জামানতের প্রয়োজনীয়তা না থাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১ম ও ২য় পর্যায়ের গৃহনির্মাণের প্রয়োজনীয় মালামাল মাইনুল ইসলাম শাওন সরবরাহকারী হিসেবে সরবরাহ ও ক্রয় করেছেন। সেক্ষেত্রে ৩য় পর্যায়ে এসে সরবরাহকারী হিসেবে জামানতের জন্য শাওনের কাছ থেকে চেক গ্রহণ করার বিষয়টি অযৌক্তিক। কারণ জামানতের প্রয়োজনীয়তা থাকলে তা ১ম পর্যায়ের কার্যক্রম সম্পাদনের সময়ই গ্রহণ করা হতো। অভিযোগকারী আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১ম ও ২য় পর্যায়ে জামানতের জন্য চেক না দিয়ে ৩য় পর্যায়ে এসে চেক দেওয়ার বিষয়ে আনা অভিযোগ একেবারেই কাল্পনিক।
এ অভিযোগটির বিষয়ে তদন্ত কমিটির মতামত হলো, উভয়পক্ষের শুনানি এবং উল্লেখিত নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, অভিযোগকারী শাওন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি একদিকে ইউএনও বরাবর অলিখিত চেক হস্তান্তর করেছেন বলে দাবি করেন। অপরদিকে একই নম্বরভুক্ত চেক বাসা থেকে বাজারে যাওয়ার সময় হারিয়ে গেছে বলে জিডি করেন। তদুপরি অভিযোগকারী শুনানিতে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে স্বাক্ষর সম্বলিত অলিখিত চেক (প্রাপকের নাম ও টাকার অঙ্ক উল্লেখ নাই) হস্তান্তর করেছেন তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণক, সাক্ষী বা প্রাপ্তি স্বীকারপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে শাওনের অভিযোগটি সত্য নয়।
অভিযোগ চ-ট: ২০২২ সালের ১৩ জুলাই মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজের হারিয়ে যাওয়া সেই চেকটি ইউএনও তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আস্থাভাজন জনৈক মো. বাবলু মৃধা, পিতা: মো. শাহজাহান মৃধা, মাতা: মোসা. ফরিদা বেগম, প্রো: মেসার্স মৃধা স্টিল, ঠিকানা: মৃধা বাড়ি, সাকিন-নিজ তাতেরকাঠী, পো: ধানধি ৮৬২০, থানা: বাউফল, জেলা: পটুয়াখালীর নাম দিয়ে ৪, ৭০, ২০, ০০০ (চার কোটি সত্তর লাখ বিশ হাজার) টাকা লিখে ডাচ বাংলা ব্যাংক, কেরাণীগঞ্জ শাখা থেকে ব্যাচের মাধ্যমে (ক্লিয়ারিং) রুপালী ব্যাংক, বাহেরচর শাখায় কালেকশনে পাঠান। প্রকৃতপক্ষে মৃধা স্টিল নামে পটুয়াখালীতে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে, চেক উপস্থাপনকারীর মৃধা স্টিল প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার কেরানীগঞ্জের কদমতলীতে অবস্থিত। উক্ত প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক একাউন্ট ডাচ বাংলা ব্যাংক কেরাণীগঞ্জ শাখায়।
একই দিন অর্থাৎ ২০২২ সালের ১৩ জুলাই ইউএনও বাহেরচর রুপালী ব্যাংক ম্যানেজারকে ফোন করে মৃধা স্টিলের উপস্থাপিত চেকের বিপরীতে শাওন এন্টারপ্রাইজের একাউন্টে ইনসাফিশিয়েন্ট ব্যালেন্স লেখার জন্য বলেন। তখন ম্যানেজার জিডির বিষয়টি উল্লেখ করে ইউএনওকে ইনসাফিশিয়েন্ট ব্যালেন্স লেখা যাবে না বলে জানায়। এ সময় ইউএনও ম্যানেজারের সঙ্গে উচ্চবাচ্চ করেন, যা অভিযোগকারী ম্যানেজারের মাধ্যমে জানতে পারেন। এছাড়া মেসার্স মৃধা স্টিল নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অভিযোগকারীর কোনো লেনদেন বা পরিচয় নেই। তিনি আদৌ ওই প্রতিষ্ঠান থেকে মালামাল ক্রয় করেননি বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন।
২০.০৭.২০২২ তারিখ আনুমানিক দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে অভিযোগকারী ইউএনওর কাছে তার স্ট্যাম্প ও চেক ফেরত চাইতে গেলে ইউএনও ক্ষমতার অপব্যবহার করে উক্ত চেক ও স্ট্যাম্প আত্মসাতের মাধ্যমে অভিযোগকারীর কাছে দুই কোটি টাকা উৎকোচ দাবি করেন। এ সময় ইউএনও তাকে পিস্তলের ভয় দেখান বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন শাওন।
এ অভিযোগের বিষয়ে ইউএনও জানিয়েছেন, অভিযোগপত্রে বর্ণিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অভিযোগকারী তার বিরুদ্ধে এমন মনগড়া ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করেছেন।
তিনি আরও জানান, হঠাৎ একদিন মেসার্স মৃধা স্টিল, কেরাণীগঞ্জের প্রো. বাবলু মৃধা নামে একজন তাকে মুঠোফোনে জানায় মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ, রাঙ্গাবালী তার প্রতিষ্ঠান থেকে চেকের মাধ্যমে মালামাল ক্রয় করে। কিন্তু উক্ত চেকটির সব টাকা তোলা সম্ভব হচ্ছে না এবং শাওনকে বহুবার ফোন করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে তিনি ইউএনওর কাছে নাগরিক হিসেবে সাহায্য কামনা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রুপালী ব্যাংক, বাহেরচর বাজার, রাঙ্গাবালীর ম্যানেজারকে ফোনে জানান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলেন। ব্যাংক ম্যানেজার তখন তাকে জানান চেকটি স্টপ পেমেন্ট হিসেবে আছে। বর্ণিত অভিযোগের বিষয়ে তিনি এর থেকে বেশি অবগত নন। অথচ অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি মেসার্স মৃধা স্টিলের মালিক বাবলু মৃধার সঙ্গে যোগসাজসে উকিল নোটিশ পাঠানোসহ উৎকোচ দাবি করেছেন, যা ভিত্তিহীন ও মনগড়া।
আর তদন্ত কমিটি বলছে, উভয়পক্ষের বক্তব্য ও উপস্থাপিত প্রমাণক পর্যালোচনায় দেখা যায়, মৃধা স্টিল, ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেড, হিসাব নম্বর-১৯৮১১০০০০২৫০৭ কর্তৃক ২০.০৪.২০২২ তারিখে ৪,৭০,২০০০০ (চার কোটি সত্তর লাখ বিশ হাজার) টাকার একটি চেক (চেক নং-সিডিসি ৪৯৯৯৯৬৫) রুপালী ব্যাংক, বাহেরচর শাখা, রাঙ্গাবালীতে ক্লিয়ারেন্সের জন্য পাঠানো হয়। সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মৃধা স্টিলের উপস্থাপিত চেক, অভিযোগকারীর দাবিকৃত উপজেলা নির্বাহী অফিসার, রাঙ্গাবালীর কাছে দাখিলকৃত স্বাক্ষর সম্বলিত অলিখিত চেক (প্রাপকের নাম ও টাকার অঙ্ক উল্লেখ নেই) এবং রাঙ্গাবালী থানায় রুজু করা জিডি এন্ট্রিতে উল্লেখিত চেকের নম্বর (চেক নং-সিডিসি ৪৯৯৯৯৬৫) একই। একই চেকের তথ্য ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে অভিযোগকারী মূলত বিভ্রান্তি তৈরি করেছেন। বর্ণিত চেকটির বিষয়ে জনৈক মো. বাবলু মৃধা, পিতা: মো. শাহজাহান মৃধা, মাতা: মোসা. ফরিদা বেগম, প্রো. মেসার্স মৃধা স্টিল, ঠিকানা: মৃধা বাড়ি, সাকিন-নিজ তাতেরকাঠী, পো: ধানধি ৮৬২০, থানা: বাউফল, জেলা: পটুয়াখালীর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাঙ্গাবালীর সাবেক ইউএনও ও বর্তমানে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাশফাকুর রহমান বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘সত্যের জয় হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। রাঙ্গাবালীতে থাকাকালীন কোনো প্রকার অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেইনি। সব সময় সৎভাবে কার্যপরিচালনার চেষ্টা করেছি।’