ছবি: বাংলাবার্তা
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ইউনিভার্সেল ট্রেড নামের বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) ডিলার নভেম্বর মাসে নিজ এলাকার কৃষকদের কাছে বিক্রির জন্য ৭৪৪ বস্তা ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়াম ফসফেট) সারের সরকারি বরাদ্দ পেয়েছেন। তিনি ওই সার নিজের গোডাউনে নিতে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সাইফুল্লাহ তাকওয়ার’কে সরকারি মূল্য পরিশোধ করেন। তবে ওই সারের চালান থেকে ৪০০ বস্তা সার মেহেরপুরের গাড়াবাড়িয়ার আমানউল্লাহ ট্রেডার্সে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ জব্দ করে। তবে এর আগেই অবশিষ্ট ৩৪৪ বস্তা সার অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
একই দিন রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ বাজারের মেসার্স সপ্তবর্ণা ট্রেডার্স নিজ এলাকার কৃষকদের জন্য নভেম্বর মাসে সরকারি বরাদ্দ পাওয়া ১ হাজার ২২১ বস্তা সার নিজের গোডাউনে নেওয়ার লক্ষ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে সরকারি মূল্য পরিশোধ করা হয়। তবে ওই সারের চালান হতে ৪০০ বস্তা সার ট্রাকে করে রাজবাড়ী সদর উপজেলায় নেওয়ার লক্ষ্যে লোড করা হলে পুলিশি অভিযানে তা জব্দ করা হয়।
তবে অবশিষ্ট ৮২১ বস্তা সার পৃথক দুইটি ট্রাকে (ঢাকা মেট্রো ট-১৬-২৮৮৬ ও চুয়াডাঙ্গা মেট্রো ট ১১-০৬৮৬) অজ্ঞাত স্থানে পাচার করা হয়। এছাড়াও রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বিসিআইসি ডিলার মেসার্স সোহাগ এন্টারপ্রাইজ স্থানীয় কৃষকের বরাদ্দের ১ হাজার ২২০ বস্তা ডিএপি সার নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার নওতারার মনিরুজ্জামানের কাছে ও একই জেলার ডোমার উপজেলার গোমনাতী বাজারে মেসার্স আদনান ট্রেডার্সে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে ট্রান্সপোর্ট চালান করা হয়েছে।
উভয় তিনটি ঘটনায় পুলিশি অভিযান পরিচালনা করে চারটি ট্রাকসহ ২ হাজার ৪২০ বস্তা ডিএপি সার জব্দ করা হয়।
এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সারের বরাদ্দ পাওয়া তিনটি বিসিআইসি ডিলার মালিককের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতদের আসামি করে অভয়নগর থানায় মামলা করেছে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। যদিও ওই সার কালোবাজারে পাচারের মূলহোতাকে ‘রাজনৈতিক চাপে’ মামলার এজাহার থেকে নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগের গুঞ্জন ছড়িয়েছে।
তবে শুধু এই সাড়ে ৩ হাজার বস্তা নয়, প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ কৃষকের জন্য সরকারি বরাদ্দের সার উচ্চ মূল্যে চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। যা হাতবদল হলেই বস্তায় বেড়ে যাচ্ছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। যার প্রভাব পড়ছে সারাদেশের বাজারে। সরকারি মূল্যে ডিলারদের কাছ থেকে সার না পেয়ে অধিক মূল্যে কিনতে বাধ্য হচ্ছে কৃষকরা। কখনো কখনো টাকা নিয়ে ঘুরেও এলাকায় সার পান না কৃষক। এভাবে চলতে থাকলে অন্তর্বতীকালীন সরকারকে বিতর্কিত করার নতুন একটি ফাঁদ সৃষ্টিরও সম্ভবনা রয়েছে।
দেশের সর্ববৃহৎ সারের মোকাম নওয়াপাড়া ঘুরে জানা গেছে, দীর্ঘ যুগ ধরেই সার কালোবাজারি চলমান রয়েছে এই মোকামে। এই অপকর্ম ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেট সদস্যরা দোকানঘর ভাড়া নিয়ে বড় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে অন্য ব্যবসার নামে কিছুটা প্রকাশ্যেই সরকারি সারের ডিও (চাহিদার বরাদ্দপত্র) কেনা-বেচা করেন। বিশেষ করে নওয়াপাড়া নৌবন্দর ঘিরে বিভিন্ন আমদানীকারকদের ঘাট থেকে খুলনা বিভাগ ছাড়াও উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলায় সার সরবরাহ করা হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা সারাদেশের বিসিআইসি ডিলারদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। এরপর তাদের মধ্য থেকে অসাধু ডিলারদের নানা ফন্দি-ফিকিরে ফেলে তাদেরকে উচ্চ লাভ দিয়ে ডিও পেপার কিনে নিজেদের নামে অথরাইজড করে নেয়। এরপর ওই সার যে এলাকায় বেশি চাহিদা সেই এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গোটা নওয়াপাড়া মোকামে ডিও কেনাবেচায় তিনটি ধাপে অর্ধশতাধিক ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। তবে সিন্ডিকেটের শীর্ষে আছে ১০-১৫ জন। তারা বিসিআইসি ডিলারের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে নিজেদের নামে অথরাইজড করে নেয়।
ওই অথরাইজে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সার উত্তোলন করে আমরা তার গন্তব্যে পৌঁছে দেব। যদিও বাস্তবে ওই সার সিন্ডিকেটের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় সারির ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। গুরুতর এই অপকর্ম প্রকাশ্যে করলেও নিজেদের রক্ষার জন্য ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কিছু নেতাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। তবে সরকার পরিবর্তন কিংবা নেতা-জনপ্রতিনিধির চেয়ার পরিবর্তন হলে সিন্ডিকেট সদস্যরাও ভোল পাল্টে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নেতাদের তুষ্ট করে শেল্টার খুঁজে নেয়।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নওয়াপাড়া মোকামে সারের ডিও কেনাবেচায় মেসার্স নবী ট্রেডার্সের মালিক মিলন মোল্যা, মেসার্স সায়রা ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ জিয়া, ফারজানা ট্রেডিংয়ের মালিক ফিরোজ হাওলাদার, মেসার্স রতি এন্টারপ্রাইজের মালিক মিথুন, মেসার্স এশিয়া এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম ফারুক, মেসার্স এ জামান এন্টারপ্রাইজের মালিক আক্তারুজ্জামান, মেসার্স আজম ট্রেডিংয়ের মালিক মোহাম্মদ মধু, মেসার্স রাফি এন্টারপ্রাইজের মালিক বেনজির, মেসার্স সোনার বাংলা ট্রেডার্সের আল-আমীন, মেসার্স লতা ট্রেডার্সের মালিক আজিজ মোহাম্মদ সিন্ডিকেটের শীর্ষে অবস্থান করছে। এদের মধ্যে একাধিক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে সার কালোবাজারির সময় ধরা পড়েছে। তবে ট্রাক চালক-হেলপারকে ম্যানেজ করে তাদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করেছেন।
সম্প্রতি ডিএপি সারের বিশাল চালান ধরা পড়লে নবী ট্রেডার্সের মালিক মিলন মোল্যার নাম প্রকাশ্যে আসে। ওই ঘটনায় মিলন মোল্যাকে আসামি করে মামলার এজাহার প্রস্তুত করে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। যদিও পরে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মতিয়ার রহমান ফারাজী নিজে থানায় গিয়ে হস্তক্ষেপ করলে মিলন মোল্যার নাম বাদ দিতে বাধ্য হয় কৃষি বিভাগ।
এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের একজন কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করলেও ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের’ কারণে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান।
এ প্রসঙ্গে থানার একজন পুলিশ অফিসার এ প্রতিবেদককে বলেন, এজাহারে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। ফলে সার কেলেঙ্কারির ঘটনায় যতো প্রভাবশালী জড়িত থাকুক তাদেরকে চার্জশিটে যুক্ত করা হবে।
জানা গেছে, অভিযুক্ত মিলন মোল্যা বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় এমপি রনজিৎ কুমার রায় ও শ্রমিক নেতা রবিন অধিকারী ব্যাচার ছত্রছায়ায় থেকে এমন কার্যক্রম চালিয়ে বিপুল অর্থ আয় করেছেন। এতে ওই রাজনৈতিক নেতারাও পেয়েছেন নানা সুবিধা। বর্তমানে তিনি ভোল পাল্টে বিএনপি নেতাদের ঘাড়ে ভর দিয়েছেন।
দেশে মধ্য নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বোরো মৌসুম, একইসঙ্গে চলছে রবি মৌসুম। ফলে সারাদেশে রয়েছে বিপুল পরিমাণ সারের চাহিদা। ওই চাহিদাকে পুঁজি করে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামানোর টার্গেট নিয়ে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। দ্রুতই গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রত্যেক এলাকায় কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সারের আগমন ও বণ্টন নিশ্চিত না করা হলে দেশে সৃষ্টি হতে পারে নৈরাজ্য। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে সারের কৃত্রিম সংকটের অজুহাতে বস্তায় ৪০০-৫০০ টাকা মূল্য বৃদ্ধি ও সংকটের খবর প্রকাশ হতে দেখা গেছে।
বাংলাবার্তা/এমআর