
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা শহরে গড়ে ওঠা নির্মাণাধীন ৩ হাজার ৩৮২টি ভবনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এসব ভবন নকশার লঙ্ঘন করে নির্মিত হওয়ায়, ভবনের অবৈধ অংশগুলো চিহ্নিত করে ভাঙার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম।
সোমবার (২১ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম আয়োজিত ‘সমস্যার নগরী ঢাকা : সমাধান কোন পথে?’ শীর্ষক নগর সংলাপে এসব তথ্য তুলে ধরেন রাজউক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, “নির্মাণাধীন ৩ হাজার ৩৮২টি ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে, যেগুলো রাজউকের নকশা বা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৈরি হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছি। নিয়মের বাইরে যতটুকু নির্মাণ হয়েছে, সেই অংশগুলোই ভেঙে ফেলা হবে।”
প্রথম ধাপে সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন, মামলা ও ভবন সিলগালা
রাজউক চেয়ারম্যান আরও জানান, প্রথম ধাপে এসব ভবনের বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। পাশাপাশি দায়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হবে এবং প্রয়োজনে ভবনগুলো সিলগালা করা হবে। “আমার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় এই প্রক্রিয়া থামবে না। ভাঙা হোক কিংবা আইনানুগ পদ্ধতিতে হোক, এসব ভবনকে নিয়মের আওতায় আনতে হবে,”— বলেন তিনি।
তিনি নগর উন্নয়নের বড় বাধা হিসেবে একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ববিভাজনকে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, “নগর উন্নয়ন তখনই কার্যকর হবে, যখন সব সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান একটি ছাতার নিচে কাজ করবে। নগর সরকার প্রতিষ্ঠা হোক বা একজন মেয়রের অধীনে সমস্ত সিদ্ধান্ত আসুক, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো—একটি কেন্দ্র থেকে সকল সেবা ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত আসা।”
ঢাকাকে পরিকল্পনার আওতায় আনতে জরুরি একীভূত উদ্যোগ
রাজউক চেয়ারম্যান উল্লেখ করেন, “ঢাকায় কেউ এখন বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে, সেসব ভবনের ব্যবস্থাপনা আমরা পরে দেখবো। তবে যেসব ভবন এখনো নির্মাণাধীন, সেগুলো কোনো ব্যত্যয় ছাড়াই নিয়ম মেনে চলবে তা নিশ্চিত করা হচ্ছে।” তিনি বলেন, নতুন করে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা আপাতত নেই। বরং দখল হয়ে যাওয়া সরকারি প্লট উদ্ধার করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
নগর সংলাপে শহরের বাস্তবতা ও সংকট চিত্র তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা
অনুষ্ঠানে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি মতিন আব্দুল্লাহ সভাপতিত্ব করেন এবং সঞ্চালনায় ছিলেন সিনিয়র সদস্য খালেদ সাইফুল্লাহ। আলোচনায় উঠে আসে ঢাকার পরিকল্পনাহীন বিস্তার, পরিবেশদূষণ, জলাবদ্ধতা, এবং অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কারণে নগরবাসীর ভোগান্তির চিত্র।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিআইপির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, “ঢাকাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা এটিকে সমস্যা-নগরীতে পরিণত করেছি। এর জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেকটাই দায়ী।” তিনি জানান, ঢাকার জন্য প্রস্তুত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী ২ কোটি ৩৫ লাখ মানুষের জন্য একটি বাসযোগ্য শহর নির্মাণের কথা বলা হয়েছে, যেখানে জোনভিত্তিক পরিকল্পনার গুরুত্ব রয়েছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান বলেন, “ঢাকা শহরের এখনকার বাস্তবতা হলো—বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলজট এবং তাপদাহে ঘেরা এক অস্থির নগর। শহরের অর্ধেক মানুষ ঘুমাতে পারেন না মাতুয়াইল ও আমিনবাজারের ল্যান্ডফিলের ধোঁয়ার কারণে। আমরা কতদিন আমাদের শিশুদের কাছে এই অপরিকল্পিত শহরের ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করবো?”
ঢাকার জন্য থাইল্যান্ড মডেল তুলে ধরলেন পরিকল্পনাবিদ
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান। তিনি বলেন, “দেশের জিডিপির এক-পঞ্চমাংশ আসে ঢাকা শহর থেকে। অথচ এখানে ঘনবসতি, যানজট, খাল দখল, খোলা জায়গা কমে যাওয়া—সবই নিয়ম লঙ্ঘনের ফল। গত আট মাসে কোনো মন্ত্রণালয় কার্যকর স্বল্প, মধ্য কিংবা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা দিতে পারেনি।”
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “ব্যাংকক শহরের অভ্যন্তরে একসময় বস্তি ছিল, কিন্তু তারা কমিউনিটি বেইজড হাউজিং এর মাধ্যমে তা উন্নত আবাসনে রূপান্তর করেছে। ঢাকায়ও একইভাবে পরিকল্পিত উদ্যোগ নিলে পরিবর্তন সম্ভব।”
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন স্থপতি সুজাউল ইসলাম খান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. নুরুল্লাহসহ নগর উন্নয়নে যুক্ত বিশিষ্টজনেরা।
প্রকাশনা ও বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
অনুষ্ঠানে নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের নিয়মিত প্রকাশনা ‘ঢাকাই’ ম্যাগাজিন এবং হেলিমুল আলম বিপ্লবের গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থ “Dhaka’s Canals on Their Dying Breath” এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইটিতে ঢাকার খাল দখল ও সংকটের ওপর গভীর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
সার্বিকভাবে, এ সংলাপ ও রাজউকের ঘোষণায় ঢাকাকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তুলতে প্রশাসনিক সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে, যদিও বাস্তবায়নই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ