
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের একতরফাভাবে নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ চালুর পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হলেও এর ভয়াবহতা থেকে এখনো রেহাই মেলেনি বাংলাদেশবাসীর। গঙ্গার প্রবাহ আটকে দেওয়ার ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলসংকট, নদীশুকিয়ে যাওয়া, নৌপরিবহন বন্ধ, কৃষিতে বিপর্যয়, মৎস্যসম্পদ ধ্বংস এবং জনজীবনে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফারাক্কার নেতিবাচক প্রভাব এখন বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার এক গুরুতর সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, নাটোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, শরীয়তপুরসহ অন্তত ২৬টি জেলার নদী-নালা-খাল শুকিয়ে গেছে। এসব জেলার মাটির নিচের পানিস্তর আশঙ্কাজনকভাবে নিচে নেমে গেছে। বড় ধরনের ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তন ঘটছে, যা একাধিক প্রজন্ম ধরে চলমান থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন ভূগোলবিদরা।
১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা এলাকায় গঙ্গার ওপর ১১৯টি লকগেটবিশিষ্ট বাঁধ চালু করে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত এই বাঁধের প্রভাব তৎক্ষণাৎ অনুভূত হলেও পরিণতি প্রকট হয়ে উঠেছে কয়েক দশকে। পদ্মা নদীর প্রবাহ ফারাক্কা থেকে কমে আসায় এর শাখা নদীগুলোর পানি সরবরাহও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শত শত বছরের প্রাকৃতিক জলপ্রবাহে ছেদ পড়ে, মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে নদীগুলো।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের কৃষক সফিকুল ইসলাম বলেন, "আমার ছোটবেলায় চকের নদীতে মালবাহী নৌকা চলত। হাটে যাওয়া, পণ্য আনা—সবকিছুই হতো নদীপথে। এখন নদীটা হারিয়ে গেছে। বালুচর হয়ে গেছে, আমরা এখন সেই নদীর বুকেই ধান ফলাই। আগামী প্রজন্ম জানবে না, এখানে একটা নদী ছিল।"
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন আরেক প্রবীণ বাসিন্দা মনোয়ার হোসেন, "পাগলা নদী ছিল আমাদের জীবনের অংশ। এখন এটা যেন একটা ডাস্টবিন। খনন করল সরকার, কিন্তু পানি তো নেই। সেই পুরনো পাগলা আর নেই।"
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানান, "মহানন্দা, পুনর্ভবা, বড়াল, নারদ, ইছামতী, গড়াই—এইসব নদীগুলো পদ্মার ওপর নির্ভরশীল। ফারাক্কার কারণে পদ্মার পানিপ্রবাহ কমায় এই শাখাগুলোর প্রায় সবই মৃত্যুপথযাত্রী। অনেক নদীতে এখন পানির বদলে ধান চাষ হয়। নৌচলাচল বন্ধ। নদীগুলোর প্রাকৃতিক রূপ বিলীন।"
বড়াল নদীর তীরে অবস্থিত আড়ানী বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, "একসময় বড় বড় নৌকা আসত আড়ানীতে। আড়ানী বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যের জোয়ার ছিল। বড়াল শুকিয়ে যাওয়ায় সেই ব্যবসা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। বড়ালের পানি তুলে কৃষিকাজ হত, এখন সেসব সেচ প্রকল্প বন্ধ।"
একসময় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ সেচ প্রকল্প ছিল। পদ্মার পানির ওপর নির্ভরশীল এই প্রকল্প এখন বন্ধের পথে। রাজশাহীর বড়াল নদী বা কুষ্টিয়ার গড়াই নদীর মতো নদীগুলোর উৎসমুখে পানি নেই। ফলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জলবিদ ও নদী গবেষক ড. আমজাদ হোসেন বলেন, "এই সংকট শুধু নদীর নয়, এটি একটি সমগ্র অঞ্চল ভিত্তিক আর্থ-সামাজিক সংকট। সেচ বন্ধ হওয়ায় ফসল উৎপাদন কমছে, মানুষের জীবিকা হুমকিতে পড়েছে। জলাধার না থাকলে গ্রীষ্মকালে তীব্র পানি সংকট হয়, যা ভবিষ্যতে মরুকরণ তৈরি করতে পারে।"
পদ্মার পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ার আরেকটি ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে দক্ষিণে। ফারাক্কার প্রভাবে নদীর নিচের দিকে লবণাক্ততা বেড়েছে, যার কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও হুমকিতে পড়েছে।
খুলনা অঞ্চলের বন কর্মকর্তা আহসান হাবিব বলেন, "মিঠাপানির অভাবে সুন্দরবনের চিংড়ি, কাঁকড়া, বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব হতে পারে দুর্বিষহ।"
বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নারদ নদীতে খনন কাজ শুরু করলেও মূল সমস্যাটি নদীতে পানি না থাকা। উত্তরে পদ্মা থেকে পানি না এলে খনন কোনো কাজেই আসবে না। একই অবস্থা পাগলা নদীর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে—খননের পরেও ফিরে আসেনি স্বাভাবিক প্রবাহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম, যিনি সম্প্রতি ফারাক্কা এলাকায় গঙ্গার পানি পর্যবেক্ষণ শেষে দেশে ফিরেছেন, বলেন, "চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি পাওয়া কথা, বাস্তবে তা আসে না। পদ্মার জৌলুস এখন আর নেই। ফলে শাখা নদীগুলোও মরতে বসেছে। দুই দেশের নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বয় ছাড়া এ সংকট কাটবে না।"
পরিবেশবিদ অধ্যাপক রফিকুল আলম বলেন, "ফারাক্কা হচ্ছে একুশ শতকের হাইড্রো-পলিটিক্যাল অপরাধ। সীমান্তের এত কাছে একটি আন্তর্জাতিক নদীর পানি আটকে দেওয়ার অধিকার কারো নেই। গঙ্গা-পদ্মা হচ্ছে একটি বহুজাতিক নদী। এভাবে বাংলাদেশকে শুকিয়ে ফেলা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের সামিল।"
ফারাক্কার প্রভাবে এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটিরও বেশি। এ ক্ষতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং জীবনধারার বিপর্যয়। নদীর বুকজুড়ে ফসলের চাষ হচ্ছে, অথচ মানুষ হারাচ্ছে জল, জীবন ও জীবিকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতের প্রজন্ম শুধু নদীর গল্প শুনে বড় হবে—নদীর জলরাশির দেখা পাবে না।
সময় এসেছে আন্তঃরাষ্ট্রীয়, কূটনৈতিক ও পরিবেশগত স্তরে নতুনভাবে ফারাক্কা ইস্যুকে তুলে ধরার। এই সংকট কোনো একক জেলার নয়—এটি গোটা দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন। বাংলাদেশের নদীগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাস ফিরিয়ে দিতে হলে প্রয়োজন বৈশ্বিক সচেতনতা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সদিচ্ছা ও দেশের অভ্যন্তরীণ শক্ত প্রতিরোধ।
এই লড়াই শুধু নদীর জন্য নয়—এটি একটি জাতির ভবিষ্যতের জন্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ