
ছবি: সংগৃহীত
ঈদুল ফিতরের ছুটির আমেজ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। এর মাঝেই রাজধানী ঢাকায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে অপরাধের ঘটনা। ছিনতাই, খুন, গুলির ঘটনা যেন এখন প্রায় নিত্যদিনের চিত্র হয়ে উঠেছে। এতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন নগরবাসী। বিশেষ করে ঈদের ছুটির পরে আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি ঘটেছে, তা এখন আলোচনার কেন্দ্রে।
সম্প্রতি রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় এক শিক্ষিকার ওপর বর্বর ছিনতাইয়ের ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর নেটিজেনদের মধ্যে ক্ষোভের ঝড় উঠেছে। ফুটেজে দেখা যায়, গত শনিবার (২৬ এপ্রিল) ভোর পৌনে ৬টার দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ফারহানা আক্তার নামের এক নারী। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের একজন প্রভাষক। এ সময় হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার দ্রুতগতিতে এসে থামে। গাড়ির জানালা থেকে এক ব্যক্তি হাত বাড়িয়ে নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ টান দেন। ব্যাগ ধরে গাড়ি টেনে নেয়ার ফলে ফারহানা আক্তার রাস্তায় ছিটকে পড়েন এবং গাড়ির সঙ্গে বেশ কিছু দূর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনায় তার কনুই ও হাঁটুতে গুরুতর আঘাত লাগে। আহত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই নির্মম ঘটনার পর শুধু সিদ্ধেশ্বরীর বাসিন্দারাই নয়, গোটা রাজধানীর নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তারা মনে করছেন, রাজধানীর রাস্তাঘাট এখন আর নিরাপদ নয়, এমনকি ভোরের শান্ত পরিবেশেও নয়।
তবে এ একক ঘটনা নয়। ঈদের পরপরই রাজধানীতে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অপরাধের ঘটনা ঘটছে। গত ২৪ এপ্রিল কারওয়ান বাজার এলাকায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জীবন নামের এক যুবককে। শহরের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকায় দিনের আলোয় এমন একটি হত্যাকাণ্ড নগরবাসীকে হতবাক করেছে। একইদিনে হাতিরঝিল এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল নেতা নাজমুল হুদাকে।
শুধু তাই নয়, ইন্টারনেট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শাহ আলী এলাকা। সেখানে একাধিকবার গুলি চালনার ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে পল্লবীর বিহারি ক্যাম্প এলাকায় টানা তিনদিন ধরে চলেছে গোলাগুলি ও সহিংসতা। একের পর এক এসব ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ চক্রগুলো আরো সাহসী হয়ে উঠছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হয়ে পড়ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনায় ৭টি মামলা হয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৩টি এবং খুনের ঘটনায় ১৯টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে। এসব পরিসংখ্যান রাজধানীতে অপরাধ বৃদ্ধির একটা ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরে। বিশেষ করে যখন দেখা যায় যে, সিদ্ধেশ্বরীর মত আলোচিত ঘটনায় ঘটনার ২ দিন পরও এখনো কোনো মামলা হয়নি, অভিযুক্তদের শনাক্ত করা যায়নি—তখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আরও বেড়ে যায়।
ডিএমপির মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, সিদ্ধেশ্বরীর ঘটনার বিষয়ে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে কাজ করছে। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিয়মিত টহল অব্যাহত রাখা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তবে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু টহল বাড়ালেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. তোহিদুল হক বলেন, "পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আইনের প্রয়োগে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে। অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে কৌশল পরিবর্তন করতে হবে।" তিনি আরও বলেন, মামলা সংখ্যা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিচার না করে বাস্তবিক অবস্থার নিরিখে অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ঈদের ছুটিতে রাজধানী ফাঁকা থাকার সুযোগ নিয়ে যেসব অপরাধী চক্র মাথাচাড়া দিয়েছে, তারা যদি দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে না আসে, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনধারা ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে ভোর কিংবা রাতের নির্জন সময়ে রাজধানীর রাস্তায় চলাচল করা আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এখন প্রয়োজন টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমে অপরাধ প্রতিরোধ করা। শুধু ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা নিলেই হবে না, বরং গোয়েন্দা নজরদারি ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অপরাধী চক্রগুলোর আগাম অবস্থান শনাক্ত করে অভিযান চালাতে হবে।
সাধারণ মানুষ এখন রাজধানীতে নিরাপদে চলাচল করতে চায়। তারা চায় একটি এমন শহর, যেখানে দিনের আলো হোক বা ভোরের নীরবতা, কোনো নারী বা নাগরিক ছিনতাই, খুন বা গুলির ভয়ে ভীত থাকবে না। এখন প্রশ্ন উঠেছে—ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কতটা দ্রুত, কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী?
বাংলাবার্তা/এমএইচ