
ছবি: সংগৃহীত
সাভারের আশুলিয়ায় অবস্থিত ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) চিত্র মঙ্গলবারও ছিল একেবারে নিস্তব্ধ। বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় আজও ডিইপিজেডের অন্তত ৯০টি কারখানায় উৎপাদন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। হঠাৎ করে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়, যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে পুরো শিল্প অঞ্চলের ওপর। এর ফলে প্রায় এক লাখ শ্রমিক বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, আর শিল্প মালিকরা পড়েছেন বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে।
হঠাৎ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন: শ্রমিক-মালিক উভয়ই দিশেহারা
ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম জানান, গতকাল (সোমবার) দুপুরে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইউনাইটেড পাওয়ারের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তিনি বলেন, "গ্যাস সংযোগ কাটা হওয়ার কারণে ইউনাইটেড পাওয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। ফলে প্রায় ৯০টি কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে।"
তিনি আরও জানান, "গতকাল দুপুরের পর কিছু কারখানা সাময়িকভাবে নিজস্ব জেনারেটর চালিয়ে কাজ চালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেটা খুব স্বল্প সময়ের জন্য সম্ভব হয়েছে। অধিকাংশ কারখানা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে। প্রায় এক লাখ শ্রমিক কর্মহীন হয়ে গেছে। তাদের দৈনিক আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে।"
ডিইপিজেড কর্তৃপক্ষ সোমবার রাত পর্যন্ত বারবার তিতাস গ্যাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। শরীফুল ইসলাম বলেন, "তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছিল যে চেষ্টা করছে গ্যাস সংযোগ পুনরুদ্ধারের জন্য। আজ সকালেও আমরা অপেক্ষা করছি, দেখি গ্যাস সংযোগ চালু হয় কি না। কিন্তু এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।"
অন্যদিকে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলছে, ইউনাইটেড পাওয়ার দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত বিল পরিশোধ করেনি। তিতাস গ্যাসের আশুলিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু ছালেহ মুহাম্মদ খাদেমুদ্দীন জানান, "দীর্ঘদিন ধরে বিল বকেয়া থাকার পরও বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু ইউনাইটেড পাওয়ার সরকারি আইন লঙ্ঘন করে বিল পরিশোধে অবহেলা করেছে। এখন তাদের প্রায় ৪৯০ কোটি টাকা (পৌনে ৫০০ কোটি) বকেয়া পড়ে আছে।"
তিনি আরও বলেন, "এটা তিতাসের একক সিদ্ধান্ত নয়। ঊর্ধ্বতন সরকারি মহলের নির্দেশেই গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আমাদের এখানে করার কিছু ছিল না।"
বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহারে যারা বড় মাত্রায় অনিয়ম করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারের নীতিগত অবস্থান। তবে, যেহেতু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়েছে এবং শিল্প উৎপাদনে ভয়াবহ ধস নেমেছে, তাই পরিস্থিতি আরো সূক্ষ্ম এবং জটিল হয়ে উঠেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে শিল্পাঞ্চলের বাস্তবতা এবং বিকল্প পরিকল্পনা থাকতে পারত। বিশেষ করে পোশাকশিল্প-নির্ভর বাংলাদেশের জন্য এমন অঘোষিত উৎপাদন বন্ধ আন্তর্জাতিক বায়ারদের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে। ফলে রপ্তানি আদেশ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।
ডিইপিজেডের কয়েকজন শিল্প মালিক জানান, তারা একদিন উৎপাদন বন্ধ থাকায় কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। বিশেষ করে যারা আন্তর্জাতিক অর্ডার নিয়ে সময়সীমার মধ্যে পণ্য সরবরাহ করতে বাধ্য, তাদের ওপর চাপ আরও বেড়ে গেছে।
ডিইপিজেডে কর্মরত শ্রমিকরা মূলত দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করেন। তাদের জীবিকা নির্ভর করে প্রতিদিনের কাজ ও মজুরির ওপর। ফলে দুই দিন ধরে উৎপাদন বন্ধ থাকায় লক্ষাধিক শ্রমিকের সংসারে হাহাকার নেমে এসেছে। অনেকেই বলছেন, আগাম কোনো নোটিশ বা বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তারা হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছেন।
শ্রমিক নেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, "একদিন কাজ বন্ধ মানে আমাদের জন্য দুই দিনের খাবার হারিয়ে যাওয়া। আজ দ্বিতীয় দিন চলছে, কিন্তু আমরা জানি না কবে আবার কাজ শুরু হবে। পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।"
বর্তমানে ইউনাইটেড পাওয়ার কর্তৃপক্ষ এবং ডিইপিজেড প্রশাসন চেষ্টা করছে দ্রুত গ্যাস সংযোগ পুনরুদ্ধারের জন্য। তবে বকেয়ার পরিমাণ এবং ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনা থাকায় সমাধান সহজ নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, যদি দ্রুত এই সমস্যা সমাধান না হয়, তাহলে শুধু ডিইপিজেড নয়, দেশের সামগ্রিক শিল্প খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষ করে বৈদেশিক রপ্তানি, শ্রমবাজার স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।
ডিইপিজেডের চলমান সংকট বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি শিল্পাঞ্চলকে স্থবির করে দিয়েছে। প্রায় এক লাখ শ্রমিকের জীবন ও দেশের শিল্প অর্থনীতি এখন এক অনিশ্চয়তার মুখে। সময়োপযোগী সমাধান ও গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই কেবল এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা সম্ভব হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ