
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর বনানীতে ২০১৮ সালে সংঘটিত বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মামুন ইমরান খান হত্যা মামলায় অবশেষে রায় দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার (১৭ এপ্রিল) দুপুরে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন দীর্ঘ ছয় বছর বিচার প্রক্রিয়া শেষে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। আদালত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক মামুন হত্যায় রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানসহ মোট ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। এর মাধ্যমে বহু আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচারিক অধ্যায়ের অবসান ঘটল, যদিও মূল অভিযুক্ত আরাভ খান এখনো বিদেশে পলাতক।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা
এই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে দুজন পলাতক—আরাভ খান এবং তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া। বাকিদের মধ্যে ছয়জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন—মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাসান ও সারোয়ার হোসেন।
রায়ের সময় আদালতে এই ছয় আসামি উপস্থিত ছিলেন। আদালত তাদের সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি রায় কার্যকরের নির্দেশ দিয়েছেন। আর পলাতক আসামিদের সাজা কার্যকর হবে গ্রেফতার বা আত্মসমর্পণের পর থেকে।
রায় ঘোষণায় আদালতের পর্যবেক্ষণ
রায়ে বিচারক বলেন, “রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। মামুন ইমরান খানের হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্বপরিকল্পিত, নির্মম এবং ভয়াবহ। এই অপরাধের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করতে আসামিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।”
তিনি আরও বলেন, “এটি কেবল একজন পুলিশ কর্মকর্তার হত্যাই নয়, বরং দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি হুমকিস্বরূপ একটি অপরাধ।”
মামলার পটভূমি
২০১৮ সালের ৮ জুলাই রাজধানীর বনানীর একটি ফ্ল্যাটে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন গাজীপুরের উলুখোলা এলাকার একটি জঙ্গল থেকে তাঁর পোড়ানো লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার বড় ভাই মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বনানী থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামুন ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দেন এবং ২০১৫ সালে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান। হত্যাকাণ্ডের চার মাস আগে তাঁকে ঢাকায় বদলি করা হয়। পুলিশি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি নাটক ও টেলিফিল্মে অভিনয় করতেন, যার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তাঁর পরিচিতি ছিল।
তদন্ত ও চার্জশিট
হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ প্রথমে আরাভ খান (তৎকালীন পরিচিতি রবিউল ইসলাম) ও তার স্ত্রীসহ মোট আটজনকে অভিযুক্ত করে। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান আদালতে দুটি পৃথক চার্জশিট দাখিল করেন। একটি চার্জশিটে আটজন সাবালক আসামির বিরুদ্ধে এবং অপরটিতে দুই নাবালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। সেই নাবালকদের বিরুদ্ধে মামলাটি এখনও ঢাকার কিশোর আদালত-৭-এ বিচারাধীন রয়েছে।
আদালত ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর মূল মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন করেন। সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণসহ বিচারিক কার্যক্রম চলতে থাকে।
পলাতক আরাভ খান ও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ
মামলার প্রধান অভিযুক্ত রবিউল ইসলাম পরে নিজের নাম পরিবর্তন করে পরিচিতি নেন ‘আরাভ খান’ নামে। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি দেশ ত্যাগ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যান এবং সেখানে স্বর্ণ ব্যবসা শুরু করেন। দুবাইতে তাঁর একটি চমকপ্রদ স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের সময় বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার ও অভিনেতাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, যা পরে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
এ মামলায় নাম আসার পর থেকেই তিনি পলাতক ছিলেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোল ‘রেড অ্যালার্ট’ জারি করে, যা এখনো সক্রিয় রয়েছে। ২০২৩ সালের ৯ মে ঢাকার একটি আদালত তাঁকে একটি আলাদা অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত
এই রায় শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের বিচারই নয়, বরং রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করে দণ্ডমুক্তির আশায় বিদেশে পলায়ন করার চেষ্টার বিরুদ্ধে একটি শক্ত বার্তা। মামলার দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া এবং আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করেছে যে, পলাতক অপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে আনা এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়।
রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, ইন্টারপোলের সহায়তায় আরাভ খানকে দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা সম্ভব হবে। মামলার বাদীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চাইছেন, এই হত্যার পূর্ণ বিচারিক প্রতিক্রিয়া বাস্তবায়ন হোক।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা একটি উচ্চপ্রোফাইল হত্যাকাণ্ডের কার্যকর পরিণতি টানতে সক্ষম হলো—যদিও এখনও অনেক পথ বাকি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ