
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিতর্কিত একটি আদেশ—যেখানে আসামি গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল—তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এই আদেশটি মূলত ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ ঘিরে দায়ের হওয়া মামলার প্রেক্ষিতে জারি করা হয়েছিল। হাইকোর্টের নির্দেশে এখন সেই বাধ্যবাধকতা আর কার্যকর থাকছে না, ফলে আসামি গ্রেপ্তারে আর কোনো প্রশাসনিক পূর্বানুমতির প্রয়োজন পড়বে না।
আজ বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে আদালত রুল জারি করে জানতে চেয়েছেন, সংশ্লিষ্ট অফিস আদেশ কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না।
গত ১০ এপ্রিল ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের স্বাক্ষরে একটি অফিস আদেশ জারি হয়। এতে বলা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ ইস্যুতে দায়ের হওয়া মামলায় কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করার আগে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। আদেশটি ছিল অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক নির্দেশনার অংশ হলেও, তা পুলিশি কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, স্বাধীনতা এবং আইনের সমতা বিষয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা দাবি করেন, এই আদেশ পুলিশের পেশাগত নিরপেক্ষতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং আইনের দৃষ্টিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে। এর বিরুদ্ধেই হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।
ডিএমপির ওই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। আজ শুনানির সময় তিনি আদালতে বলেন, “রাষ্ট্রের আইন সবার জন্য সমান। কোনো একটি নির্দিষ্ট আন্দোলন বা ঘটনায় আসামিদের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া আলাদা হলে তা হবে সাংবিধানিক সমতার চরম লঙ্ঘন। দেশের স্বার্থে, মানুষের অধিকার রক্ষায় এই রিট আমি বিনা পারিশ্রমিকে লড়ছি।”
শুনানি শেষে আদালত আদেশটি তিন মাসের জন্য স্থগিত করে এবং রুল জারি করে। আদালত জানতে চেয়েছেন, “ডিএমপি কমিশনারের এই অফিস আদেশ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না?”
হাইকোর্টের এই রায়ের পর দেশের প্রথিতযশা আইনজীবী ও নাগরিক অধিকার কর্মীরা স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। মানবাধিকার আইনজীবী জেডআই খান পান্না বলেন, “ডিএমপির আদেশটি স্পষ্টত পুলিশি শক্তিকে রাজনৈতিক প্রভাবের আওতায় আনার একটি কৌশল ছিল। হাইকোর্ট তার স্থগিতাদেশ দিয়ে নাগরিক অধিকার ও আইনের শাসন রক্ষার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।”
একই মত প্রকাশ করেন সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। তিনি বলেন, “আইনের চোখে সবাই সমান। যদি কোনো মামলার আসামিকে গ্রেপ্তারে বিশেষ অনুমতি লাগে, তাহলে তা অন্য আসামিদের সঙ্গে বৈষম্য সৃষ্টি করে, যা সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।”
ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “অফিস আদেশটি আমরা নিয়ন্ত্রণমূলক ও কৌশলগত কারণে দিয়েছিলাম। এতে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না। তবে হাইকোর্টের আদেশ আমরা সম্মানের সঙ্গে মেনে চলবো এবং পরবর্তী আইনি নির্দেশনার অপেক্ষায় থাকবো।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিএমপির আদেশটি জারির পর থেকেই ব্যাপক সমালোচনা হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, কেন একটি নির্দিষ্ট আন্দোলনের মামলায় বিশেষ অনুমতি দরকার হবে? কেউ কেউ এটিকে “রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট আসামিদের নিরাপত্তা দেওয়া চেষ্টা” বলেও অভিহিত করেন।
বিশেষ করে গত কয়েক মাস ধরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে পুলিশের কঠোর ভূমিকা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগ উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের রায়কে অনেকেই “আইনের শাসনের বিজয়” হিসেবে দেখছেন।
আইনের সমতা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হাইকোর্টের এই আদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নজির তৈরি করেছে। ডিএমপির অফিস আদেশ যে শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, বরং তা আইনের মৌলিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে—এই বার্তা দিয়েছে আদালত।
আদালতের চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত এই আদেশ তিন মাসের জন্য স্থগিত থাকবে। পরবর্তী শুনানিতে যদি আদালত রুলের পক্ষে রায় দেন, তবে এ ধরনের গ্রেপ্তার বাধা সংক্রান্ত আদেশ ভবিষ্যতে অবৈধ বলেও গণ্য হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ