
ছবি: সংগৃহীত
সেলিব্রিটিদের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে হাইকোর্ট। এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে সাত সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
রোববার (২৭ এপ্রিল) হাইকোর্টের বিচারপতি ফাতেমা নজিব ও বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে এ আদেশ দেন।
আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (BFIU) প্রধানকে নিয়ে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করতে হবে।
এই কমিটিকে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের বাস্তব চিত্র, এর প্রভাব, আইনগত দিক ও নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ বিষয়ে তদন্ত করে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
আদালতের রুল : জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন বন্ধে পদক্ষেপ না নেওয়া কেন বেআইনি হবে না? শুধু তদন্ত কমিটি গঠনই নয়, আদালত একযোগে রুলও জারি করেছেন। রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে, সেলিব্রিটিদের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মূলধারার গণমাধ্যমে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন ও প্রচার বন্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না,
জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিটিআরসি চেয়ারম্যান, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রধানকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
হাইকোর্টে এই রিট আবেদনটি দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম রাফিদ। গত ১৬ এপ্রিল তিনি রিট আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী জুয়া ও বেটিং নিষিদ্ধ। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইউটিউব, ফেসবুক, টিভি চ্যানেলসহ মূলধারার বিভিন্ন মাধ্যমে সেলিব্রিটিদের অংশগ্রহণে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে।
এতে করে তরুণ সমাজ বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এটি হুমকি হয়ে উঠছে। তাই অনলাইন জুয়া ও বেটিং বন্ধে কার্যকর ও স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনেরও অনুরোধ জানানো হয় রিটে।
রবিবার আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান ও ব্যারিস্টার মো. আশিকুর রহমান। আদেশের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান।
বর্তমানে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটগুলোর বিজ্ঞাপন দিন দিন বেড়ে চলেছে। মূলধারার জনপ্রিয় শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালীরা (ইনফ্লুয়েন্সার) এসব বিজ্ঞাপনে যুক্ত হচ্ছেন।
এর ফলে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ দ্রুত লাভের আশায় অনলাইন জুয়ার ফাঁদে পড়ছে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়াও মানসিক অবসাদ, অপরাধ প্রবণতা এবং পারিবারিক সংকট বাড়ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ। ১৮৬৭ সালের পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট এবং দ্য প্রিভেনশন অব গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী জুয়া চালানো ও এতে অংশগ্রহণ করা অপরাধ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনও অনলাইন জুয়া রোধে প্রযোজ্য।
বর্তমানে বিভিন্ন অভিনেতা, গায়ক, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্মের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর কিংবা বিজ্ঞাপন প্রচারক হিসেবে কাজ করছেন। এই বিষয়টিকে শুধু আইনগত নয়, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।
তরুণরা যখন তাদের প্রিয় তারকাদের এসব সাইটের বিজ্ঞাপন করতে দেখে, তখন তারা সহজেই প্রভাবিত হয়ে পড়ে। ফলে শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, সামগ্রিক সামাজিক অবক্ষয়ের ঝুঁকিও বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, হাইকোর্টের এই আদেশ একটি সময়োপযোগী ও যুগান্তকারী উদ্যোগ। যদি সঠিকভাবে তদন্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে অনলাইন জুয়া ও বেটিং সাইটের অবাধ বিস্তার অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। একইসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় এটি সহায়ক হবে।
তবে অনেকেই বলছেন, শুধু তদন্ত কমিটি গঠন নয়, প্রয়োজনে নতুন করে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সেলিব্রিটিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবা উচিত। কারণ সচেতনতার পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে এই অনৈতিক প্রবণতা বন্ধ করা কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ