দিলীপ ও দোলন
ঢাকা: কখনো ছিলেন না আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে,তবুও হয়েছেন রাজনৈতিক নেতা। গড়ে তুলেছেন সাম্রাজ্য আর হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। তারা হলেন, ডায়মন্ডের ওয়াল্ড লিমিটেডের মালিক দিলীপ কুমার আগরওয়াল ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি এনামুল হক দোলন। এদের মধ্যে দিলীপ কুমার আগরওয়াল ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য বি.ষয়ক উপকমিটির সদস্য।
জানা যায়, দিলীপ কুমার আগরওয়ালের সিন্ডিকেট ছিলো এতোটাই প্রখর যে দুদকের দুর্নীতির অনুসন্ধানের হাত থেকেও তিনি বেরিয়ে যান। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারকে ব্যবহার করে দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়ের হওয়া অভিযোগ কামকাওয়াস্তে অনুসন্ধান করিয়ে ক্লিন সার্টিফিকেট নেন। এমনকি আওয়ামী সরকারের বড়বড় নেতাদের দুদক থেকে বাঁচতে উপঢৌকনও দেন এই দিলীপ কুমার আগরওয়াল। বৈধ উপায়ে সোনা আমদানির সুযোগ থাকলেও মুনাফার লোভে চোরাচালানের সিন্ডিকেট গড়েছিলেন দোলন-দীলিপ। আকাশ, স্থল ও সমুদ্র—তিন পথেই হয় সোনা চোরাচালান। হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারেও সরাসরি সম্পৃক্তও রয়েছে এই চক্রটি। নোয়াখালী-১ (চাটখিল-সোনাইমুড়ি) আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য এইচ এম ইব্রাহীমও ছিলেন এই সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য।
জানা যায়, তাদের মাধ্যমেই দোলন-দীলিপ সিন্ডিকেটকে সরাসরি মদদ দিতেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এই সিন্ডিকেট থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। সম্পৃক্ততা ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদেরও।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দিলীপ কুমার আগরওয়ালের আকাশচুম্বী উত্থানের নেপথ্যে আছে ভয়ংকর চোরাকারবার ও প্রতারণার গল্প। একসময়ের সামান্য ঠিকাদার দুই দশকের ব্যবধানে হয়ে উঠেছেন বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (সিআইপি)। তার পৈতৃক নিবাস চুয়াডাঙ্গায় সরেজমিনে অনুসন্ধানকালেও নানা অবিশ্বাস্য কাহিনি বেরিয়ে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও দিলীপের রাতারাতি বিত্তশালী বনে যাওয়ার ঘটনাকে রীতিমতো আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়া বলেই জানান।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাগজে-কলমে দিলীপ কুমার আগরওয়ালের বার্ষিক আয় চার কোটি চার লাখ ৩৯ হাজার ৮৫৪ টাকা। তার ওপর নির্ভরশীলদের আয় তিন কোটি ৫৭ লাখ ১২ হাজার ৩৮২ টাকা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সোনা ও নকল হীরা বিক্রি করে দিলীপ কুমারের বার্ষিক আয় আরো কয়েক গুণ, যা দিয়ে বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি।
৩০ নভেম্বর ২০২৩ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দিলীপ কুমারের নগদ ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ প্রায় ১৩ কোটি ছয় লাখ ৬৮ হাজার ৭০৪ টাকা রয়েছে। অস্থাবর সম্পদ রয়েছে মোট ১৯১ কোটি ৯৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৩৪ টাকার। স্ত্রীর নামে রয়েছে ৪৯ কোটি ৭৯ লাখ ২১ হাজার ৩১১ টাকার অস্থাবর সম্পদ। তার স্ত্রীর কাছে নগদ ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ অন্যান্য বিনিয়োগ রয়েছে ২০ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার ২৩২ টাকা। তার ওপর নির্ভরশীলদের অস্থাবর সম্পদ রয়েছে ৩৫ কোটি দুই লাখ ৬০ হাজার ৪৮২ টাকা। এ ছাড়া তাদের কাছে নগদ ও বৈদেশিক মুদ্রাসহ অন্যান্য বিনিয়োগ রয়েছে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা।
তথ্য সূত্র বলছে, ঢাকা ও চুয়াডাঙ্গায় স্থাবর সম্পদ রয়েছে দিলীপ কুমারের। কৃষিজমি রয়েছে পাঁচ একরের বেশি, যার মূল্য সাত কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৭৪ টাকা। অকৃষি জমি রয়েছে এক একরের বেশি, যার মূল্য ৮০ লাখ ৩৫ হাজার ৮০০ টাকা। দালান রয়েছে ৯৪ হাজার ৮৪৯ বর্গফুট, যার মূল্য ৩০ কোটি ৪৭ লাখ ৯৩ হাজার ১৮৮ টাকা। বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ২,৫২৬ বর্গফুট, যার মূল্য ৭৫ লাখ সাত হাজার ৮০০ টাকা। স্ত্রীর স্থাবর সম্পদ রয়েছে মোট ৩৯ কোটি ৪৯ লাখ ৬৪ হাজার ৬৬২ টাকার। অভিযোগ রয়েছে, পাচার করা টাকায় ভারত ও অস্ট্রেলিয়ায় খুলেছেন একাধিক জুয়েলারি শোরুম।
আরও অভিযোগ রয়েছে, গ্রাহকদের মোজানাইট কিংবা জারকান পাথরকে আসল হীরার গ্যারান্টি দিয়ে প্রতারণা করছে দিলীপ আগরওয়ালের ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। এ সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্তে ২০১৭ সালের ১৮ অক্টোবর তদন্ত কমিটি গঠন করে দুদক। কিন্তু আজও তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি। এদিকে দুদকের তদন্তের পর ২০১৮ সালে প্রথম হীরা আমদানি করে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। ওই বছর তিন হাজার ক্যারেটের অমসৃণ হীরার দুটি চালান আমদানি করে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড। এর আগে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। এর আগের ১৩ বছর কোথা থেকে এই ডায়মন্ড সংগৃহীত হতো সেই প্রশ্নও রয়েছে। এগুলো নকল বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের মে মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রথম মসৃণ হীরা আমদানি এবং পরবর্তী সময়ে রপ্তানি করে সাভারের মির্জানগরের এইচআরসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের ব্রিলিয়ান্ট হীরা লিমিটেড।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর বায়তুল মোকাররমে সোনার মার্কেটে ব্যবসার সুবাদে দিলীপ কুমার আগরওয়াল ও এনামুল হক খান দোলনের সখ্য বাড়ে। অতিমুনাফার লোভে জড়িয়ে পড়েন চোরাকারবারিতে। প্রথমে স্থলপথে চুয়াডাঙ্গায় সোনা চোরাচালান শুরু করে এই সিন্ডিকেট। পরবর্তী সময়ে আকাশপথে এবং আগরওয়ালের তারা দেবী শিপিং অ্যান্ড সি ট্রেডের মাধ্যমে জলপথেও সোনা পাচার করতেন তাঁরা।
সূত্র বলছে, এনামুল হক খান দোলনের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান ডায়মন্ড অ্যান্ড ডিভার্স, শারমিন জুয়েলার্স ও নোবডি ইন্টারন্যাশনাল। ডায়মন্ড ডিভার্স ও শারমিন জুয়েলার্সের আড়ালে মূলত সোনা চোরাচালন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে সিন্ডিকেটের সদস্যদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলা গোল্ড (প্রাইভেট) লিমিটেড।
এদিকে গোয়েন্দা তথ্য বলছে, সোনা চোরাকারবারে নেতৃত্ব দেওয়ার সঙ্গে অর্থপাচার, অস্ত্র ও মাদক কেনাবেচায় যুক্ত রয়েছেন দোলন। এসব তথ্য উঠে এলে নড়েচড়ে বসে বিভিন্ন সংস্থা। তবে পরিস্থিতি টের পেয়ে গাঢাকা দেন এই চোরাকারবারি। সূত্র বলেছে, ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল একটি ফ্লাইটে থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান তিনি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের হাত ধরে পুনরায় দেশে ফেরেন।
সরেজমিনে এনামুল হক খান দোলনের বাড়ি মনোহরদী উপজেলার কাঁচিকাটা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সিঅ্যান্ডবি-পোড়াদিয়া আঞ্চলিক সড়কের খানবাড়ি বাসস্ট্যান্ডের পাশেই ২০ বিঘা জমির বাগানবাড়ি এনামুল হক খান দোলনের। পুরো জমিটাই সিমেন্টের পিলার ও নেট দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা। এর ভেতর বিভিন্ন ফুল, ফলের গাছ লাগানো রয়েছে। একটু সামনে এগোতেই সাত বিঘা জমির ওপর অত্যাধুনিক বিলাসবহুল দ্বিতল ভবনের আলিশান বাড়ি। পাঁচতারা মানের এই অভিজাত বাড়িটিই খানবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এই বাড়িটি নির্মাণের জন্য যাবতীয় ফিটিংসসহ গৃহসজ্জার উপকরণ আনা হয় দুবাই ও ইতালি থেকে। বাড়ির পাশেই একটি নান্দনিক মসজিদ ও বাড়ির সীমানায় রয়েছে একটি সুবিশাল পুকুর। স্থানীয় লোকজন বলছে, বিলাসবহুল বাড়িটির নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা। এ ছাড়া নরসিংদী, ঢাকায় দোলনের নামে-বেনামে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
এদিকে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এনামুল হক খান দোলন দুবাই ও সিঙ্গাপুর সিন্ডিকেটের সহায়তায় দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আসা বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে স্বর্ণ ও স্বর্ণালংকার দেশে পাঠান এবং বিধিবহির্ভূতভাবে মূল্য পরিশোধসহ বিদেশে অর্থ পাচার করেন। বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে এনামুল হক খান দোলনের মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছে দুবাইয়ের ফিন্যানশিয়াল ইল্টেলিজেন্স ইউনিট। তার বিরুদ্ধে দুবাইভিত্তিক সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার তথ্য দিয়েছে দুবাইয়ের অর্থপাচার প্রতিরোধ ইউনিট। চোরাচালানের রহস্য উন্মোচনের জন্য দোলনকে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মজুদ সব স্বর্ণের হিসাব নিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এনামুল হক খান দোলন, তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যার ব্যাংক হিসাব তলব করেছিল বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের চাপের মুখে তদন্তেআলোর মুখ দেখেনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে দিলীপ কুমার আগরওয়ালকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোনটি রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে মতামত জানতে এনামুল হক দোলনকে ফোন দিলে তিনিও ফোনটি রিসিভ করেননি।
বাংলাবার্তা/আরএম/ওআর