ফটো কোলাজ: বাংলাবার্তা
ভরা মৌসুমে মুখ থুবড়ে পড়েছে খাদ্য বিভাগের ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচি। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সরকারি খাদ্যগুদামগুলো বহুলাংশ শূন্য হয়ে পড়বে। তাই প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
জেলায় জেলায় খাদ্য অধিদপ্তরের আওতায় ধান-চাল সংগ্রহে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকরা। ফলে আগামীতে সরকারের বেঁধে দেওয়া খাদ্য সংগ্রহ কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় মিল মালিকরা ধানের উচ্চমূল্য এবং ধান না পাওয়ার জন্য দুষছেন ছোট চাতাল ও স্টক ব্যবসায়ীদের।
সরকারিভাবে মোটা চাল ৪৭ টাকা রেট নির্ধারণ হলেও বাজারমূল্য রয়েছে ৫১- ৫২ টাকা। সেক্ষেত্রে মিল মালিকরা লস দিয়ে সরকারকে চাল ও ধান না দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ায় মিল মালিকদের ওপর চড়াও হয়ে ধান সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানেও একই দশা বিরাজমান।
তবে খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার গত ১৫ ডিসেম্বর নীলফামারী এবং ২১ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের সব জেলা প্রশাসক এবং জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে মতবিনিময় করার পর জানান, সেখানে আগামী জানুয়ারি মাসে আমন ধান ও চালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।
সেখানে জেলা প্রশাসক ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে জোর তাগিদ দেওয়া হয়।
সরকার চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সারা দেশ থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন ধান চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে চলতি মৌসুমে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় চালের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯২ হাজার ৭২৯ টন, ৫৩ হাজার ৩৫৯ টন ধান ও আতপ চাল ১৩ হাজার ৯৫০ টন। এখন পর্যন্ত অর্জিত হয়েছে চাল ২৮ হাজার ৫৫ টন ও ধান ২০৬ টন। এ পর্যন্ত আট জেলা থেকে লক্ষ্যমাত্রার ২০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে।
এদিকে রংপুরে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ধান ৭৫ হাজার ৯৪০ টন, সিদ্ধ চাল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৫৪ টন এবং আতপ চাল ১৮ হাজার ১৬৪ টন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধান ২০ শতাংশ, চাল ৩২ শতাংশ ও আতপ চাল ২৭ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে। গত ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে এক মাস পাঁচ দিনে দুই বিভাগে গড়ে ২০ ভাগের ওপরে সংগ্রহ হয়নি বলে তথ্যে জানা গেছে।
উত্তরাঞ্চলের চালসমৃদ্ধ জেলাগুলো থেকে প্রতিদিন শতাধিক ট্রাক চাল দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। সেখানেও চাল পাঠানোর বিষয়টি কমে গেছে। এটি জানিয়েছেন মিল মালিকরা। ফলে বাজারে হুহু করে বাড়ছে চালের দাম।
দিনাজপুরে সবচেয়ে বড় মোকাম বাহাদুর বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা। বগুড়া, নওগাঁ, শান্তাহার ও জয়পুরহাটে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এটি আরও বাড়তে পারে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। চালের দাম
বেড়ে যাওয়ায় নিম্নআয়ের খেটে খাওয়া মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল দেশের অন্যান্য জেলার অবস্থা আরও করুণ।
বাজার ঘুরে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, জিরাশাইল এক সপ্তাহ আগে ছিল ৭৫ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা। নাজিরশাইল আগে ছিল ৮০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৪ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে। বিআর২৮ ও বিআর ২৯ চাল এক সপ্তাহ আগে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকা থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে। গুটি স্বর্ণা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হচ্ছিল ৫০ টাকা কেজি দরে। এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪ টাকা করে। ২৫ কেজির বস্তায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা এবং ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে ২০০ টাকা।
এদিকে ঢাকার টঙ্গী, মোহাম্মদপুর, উত্তরাসহ বিভিন্ন মিলের প্রতিনিধিদের একজন একলাম বলেন, ধান পাওয়া যাচ্ছে না বিধায় মিল মালিকরা চালের দাম বস্তাপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
দিনাজপুরের জহুরা অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মো. আব্দুল হান্নান বলেন, ‘চালের বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই।’
শান্তাহারের বৈশাখী অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী ইসমাইল হোসেনও একই কথা জানান। রাজশাহীর নাবিল অটো রাইস মিলের ম্যানেজার খাইরুল ইসলাম, নওগাঁর বেলকম অটো রাইস মিলের ম্যানেজার চঞ্চল হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এরফান অটো ও মোজাম্মেল অটো রাইস মিলের প্রতিনিধিরাও একই কথা জানান। বগুড়া জেলা খাদ্য কর্মকর্তা রেজানুর রহমান জানান, বগুড়া জেলায় ৩২ হাজার টন চাল ও ১২ হাজার টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৯ হাজার টন চাল ও ৫ হাজার টন ধান সংগ্রহ হয়েছে। জেলায় ৭৯৭টি চালকল সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে।
একটি সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীর ৮ জেলা ও রংপুর বিভাগের ৮ জেলাসহ মোট ১৬ জেলায় ১০ হাজারের বেশি মিল মালিক সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। তাদের উৎপাদনের ২৫ শতাংশ সরকারের খাতে দেওয়ার চুক্তি রয়েছে। গত ১৭ নভেম্বর থেকে আমন কর্মসূচির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, যা চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। গত এক মাসে আমন মৌসুমে চাল ও ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা খুব নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। এদিকে বিগত দিনে মিল মালিকদের লাইসেন্স বাতিলসহ টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে ধান-চাল সংগ্রহ করা হয়েছিল। এবারও প্রশাসন সে পথেই হাঁটছে।
বাংলাবার্তা/এমআর