
ছবি: সংগৃহীত
রমজান ও ঈদুল ফিতর ঘিরে বাজারে তুলনামূলক স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও ঈদের ছুটি শেষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের খুচরা বাজারগুলোতে আবারও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তাদের অভিযোগ, এর পেছনে অন্যতম কারণ বাজার তদারকির কার্যক্রমে শৈথিল্য এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট চক্রের সক্রিয়তা।
রোজা ও ঈদের আগে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য সংস্থাগুলোর সক্রিয় বাজার তদারকি কার্যক্রমের ফলে ভোক্তারা বেশ কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলেও ঈদের ছুটির পর থেকে সেই তদারকি কার্যক্রমে দৃশ্যমানভাবে ধীর গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এতে করে বাজারে সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
দাম বাড়ছে আগাম বার্তা ছাড়াই
বুধবার রাজধানীর নয়াবাজার, শ্যামবাজার, খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর, মালিবাগসহ একাধিক বড় ও ছোট বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পেঁয়াজ, আলু, সবজি, মাছ, ডিম, তেল, চালসহ প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
নয়াবাজারে বাজার করতে আসা মো. সালাউদ্দিন বলেন, “রোজায় বাজারে জবাবদিহির পরিবেশ ছিল, কর্মকর্তারা ঘুরে ঘুরে দেখতেন, সেই কারণেই দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু এখন দেখছি সেই দৃশ্যপট নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা আবারও লাগামহীনভাবে দাম বাড়াচ্ছেন।”
পেঁয়াজ, আলু ও ডিমের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি
খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকায়, যা ঈদের আগে ছিল সর্বোচ্চ ৫০ টাকা। মাসখানেক আগে এই পেঁয়াজই বিক্রি হচ্ছিল ৩৫-৪০ টাকায়। আলুর দামও বেড়ে কেজিতে ৩০ টাকায় পৌঁছেছে, যা ঈদের আগে ছিল ২৫ টাকা।
ডিমের বাজারেও বেড়েছে অস্থিরতা। প্রতিডজন ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়, যা আগে ছিল ১২৫-১২৮ টাকা। সরবরাহ ঘাটতির কোনো প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন।
তেল নিয়ে নতুন দুশ্চিন্তা
সরকারি ভর্তুকির মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে বোতলজাত ও খোলা তেলের দাম হঠাৎ লাফিয়ে বেড়েছে। বোতলজাত সয়াবিন তেল লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাঁচ লিটারের বোতল এখন বিক্রি হচ্ছে ৯২২ টাকায়, যা আগে ছিল ৮৫২ টাকা।
খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬৯ টাকা। এ মূল্যবৃদ্ধি শুধু মধ্যবিত্ত নয়, নিম্নআয়ের মানুষের জন্যও গুরুতর প্রভাব ফেলছে।
মাছ, মাংস ও সবজিতেও আগুন
চাহিদা ও সরবরাহের অজুহাতে মাছের দামও বেড়ে চলেছে। পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকায়, যা আগে ছিল ১৮০-১৯০ টাকা। তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে ২০০-২২০ টাকা, চাষের কই ২৫০ টাকা, বড় রুই ৩৫০-৪০০ টাকা এবং মাঝারি রুই ৩০০-৩২০ টাকা।
চিংড়ির বাজারে আরও ভয়াবহ অবস্থা। চাষের চিংড়ি ৬৫০-৭৫০ টাকা কেজি, নদীর চিংড়ি ৮০০-১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। শিং ও ট্যাংরা মাছের দাম পৌঁছেছে যথাক্রমে ৯০০ এবং ৮০০ টাকায়।
সবজির বাজারেও স্বস্তির লেশমাত্র নেই। টমেটো, শসা, পেঁপে, কাঁচামরিচ, লেবু—সবকিছুর দাম কেজিতে ৫-১৫ টাকা করে বেড়েছে। টমেটো কেজি ৬০-৬৫, শসা ৬০-৭০, কাঁচামরিচ ১২০ টাকা, পেঁপে ৬০ টাকা এবং একটি লেবু বিক্রি হচ্ছে ৮-১০ টাকায়।
চাল-ডাল-তরকারিতেও সিন্ডিকেটের ছায়া
সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে আমন মৌসুমে বাড়ানো চালের দাম এখনো কমেনি। খুচরা বাজারে সরু চাল কিনতে কেজিতে ৮৫ টাকা, আর মোটা চাল কিনতেও গুণতে হচ্ছে ৫৫ টাকা। ডাল, রসুন, আদা, হলুদ, জিরা, এলাচ, লবঙ্গের দাম ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী।
রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৬০-২৪০ টাকায়, আদা ১০০-২০০ টাকায়, হলুদ ৪০০-৪২০ টাকা, জিরা ৬৫০-৭৫০ টাকা, লবঙ্গ ১৬০০ টাকা এবং এলাচ ৫১০০ টাকা কেজি দরে।
ক্যাবের পরামর্শ ও উদ্বেগ
এই পরিস্থিতিতে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “ঈদের আগে বাজার তদারকির কারণে ভোক্তারা স্বস্তিতে ছিল। এখন সেই তদারকির অভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সরবরাহ থাকলেও মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যৌক্তিকতা নেই। দ্রুত বাজার মনিটরিং জোরদার করে আইনের আওতায় আনতে হবে দোষীদের।”
তিনি আরও বলেন, “পণ্যমূল্য বাড়লে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের মানুষদের। তাদের ন্যূনতম চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়ে। শুধু রোজা-ঈদ নয়, সারাবছরই তদারকি চালিয়ে যেতে হবে।”
ঈদের পর বাজারে পণ্যমূল্যের এমন অস্বাভাবিক উল্লম্ফন জনসাধারণের জীবনে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। বাজার তদারকি পুনরায় সক্রিয় করা এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি। দীর্ঘমেয়াদে স্বস্তির জন্য দরকার একটি কার্যকর ও নিয়মিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা, যা কেবল উৎসবকালীন নয়, সারাবছর অব্যাহত থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ