
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন যেন এক বিশাল লুটপাটের খনি। চলমান কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তদন্তে উঠে এসেছে দেশের সাতটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার বেনামি ঋণের তথ্য। এই কেলেঙ্কারির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দুই প্রভাবশালী গ্রুপ—এস আলম ও বেক্সিমকো। ব্যাংকের ভেতরের অসাধু কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ভুয়া প্রতিষ্ঠান, অস্তিত্বহীন কোম্পানি এবং জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে বিপুল অঙ্কের ঋণ, যার সিংহভাগই আদায়যোগ্য নয় এবং বর্তমানে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
কে কত ঋণ নিল, কিভাবে
তদন্তে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি বেনামি ঋণ নিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। এ গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদের নেতৃত্বে নেওয়া বেনামি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। যার বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। এস আলম গ্রুপের ব্যাংকঋণের মোট পরিমাণ ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা, যার ৫৯ শতাংশই বেনামে নেওয়া।
এর মধ্যে ৯৮ হাজার কোটি টাকা সরাসরি ব্যাংকঋণ এবং বাকি ৩৪ হাজার কোটি টাকা পরোক্ষ ঋণ—যেমন এলসি, ব্যাংক গ্যারান্টি, রপ্তানি বিল বিক্রি ইত্যাদির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে, এই ঋণের একটি বড় অংশ এস আলম গ্রুপ নিজস্ব মালিকানাধীন কিংবা প্রভাবাধীন ব্যাংক থেকে নিয়েছে। বিশেষ করে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে নেওয়া প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
বেনামি ঘুঁটিতে বেক্সিমকোর তৎপরতা
এদিকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ। এ গ্রুপ বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আর গ্রুপটির নামের অধীনে খোলা ১৮৮টি কোম্পানির মধ্যে ৭৮টি প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র ঋণ নিতেই ব্যবহৃত হয়েছে।
বেক্সিমকোর গ্রুপ ঋণের মোট পরিমাণ এখনো নিশ্চিত না হলেও খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৫৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে একাধিক প্রতিষ্ঠান এমন রয়েছে, যাদের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে শুধুমাত্র ঋণের টাকা তুলতেই—এমনকি টাকা তোলার পরই সেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এইভাবে জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছে গ্রুপটি, এবং কয়েকটি বেনামি ঋণের দায় তারা পরে স্বীকার করে চিঠিও দিয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভূমিকা
এই বিশাল লুটপাট কার্যক্রমে সবচেয়ে বড় সহায়তা করেছে ব্যাংক কর্মকর্তারাই। গ্রাহকের পরিচিতি যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও, ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলা, ঋণ ছাড় করার পর কাগজপত্র সরবরাহ, এমনকি আমদানির আড়ালে ডলার পাচার—সবই হয়েছে ব্যাংকের ভেতরের সহযোগিতায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ঋণের টাকা ছাড় হওয়ার পর কাগজপত্র প্রদান করা হয়েছে, যেন একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল বৈধতার মুখোশ পরানো।
আরও যেসব গ্রুপ জড়িত
এই কেলেঙ্কারিতে নাম জড়িয়েছে আরও বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী গ্রুপের:
নাবিল গ্রুপ: মোট ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে, যার মধ্যে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকাই বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া।
আরামিট গ্রুপ: প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন এই গ্রুপ নিয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার বেনামি ঋণ। এসব ঋণের বড় অংশই নেওয়া হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে, যেটির নিয়ন্ত্রণ ছিল তার পরিবারের হাতে।
নাসা গ্রুপ: ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেনামি ঋণ নিয়েছে।
সিকদার গ্রুপ: তাদের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যার একটি বড় অংশ পেয়েছে প্রয়াত সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
বেনামি ঋণের বিপদ এবং ভবিষ্যৎ ব্যবস্থা
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব বেনামি ঋণ শনাক্ত করে মূল সুবিধাভোগীর নামে দেখানোর নির্দেশ দিচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। কিছু গ্রুপ দায় স্বীকারও করেছে। তবে এ পর্যন্ত যা বেরিয়েছে, তদন্ত এগোলে আরও বড় অঙ্কের লুটপাটের তথ্য সামনে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
দুর্নীতির বিস্তার এতটাই ভয়াবহ যে, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন থাকা সত্ত্বেও এসব ঋণ বাস্তবে গচ্ছিত আমানতের টাকা সরাসরি আত্মসাৎ করার মতো। রাজনৈতিক সংযোগ, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ, এবং নজরদারির অভাব মিলিয়ে ব্যাংক খাত এখন একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা পার করছে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কেবল তদন্ত নয়, প্রয়োজন কঠোর আইনগত ব্যবস্থা, স্বাধীন আর্থিক কমিশন এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। অন্যথায়, আমানতকারীর টাকা নিয়ে এমন ‘উধাও হওয়ার’ ঘটনা বারবার ঘটবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ