
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় কিস্তি সফলভাবে ছাড় হলেও চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পাওয়ার বিষয়ে এবার সরাসরি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি আইএমএফ। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) দুই সপ্তাহব্যাপী পর্যালোচনা পর্ব শেষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এখনো আলোচনা চলছে এবং সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে আগামী জুন মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ একসঙ্গে দুটি কিস্তির অর্থ পেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এই সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থাটির গবেষণা বিভাগের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার প্রধান ও মিশনপ্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও। তার সঙ্গে আরও ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিলেন।
আইএমএফ-এর মূল্যায়ন: উন্নতি কিছু হলেও কাঙ্ক্ষিত নয়
ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, "বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় কিছুটা বেশি, আর বিনিময় হারও তুলনামূলক স্থিতিশীল। তবে ব্যাংকিং খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা, বিশেষ করে খেলাপি ঋণের উচ্চ হার—এটি এখনও বড় উদ্বেগের জায়গা।"
আইএমএফ এর আগেও বাংলাদেশকে পরামর্শ দিয়েছিল সরকারি ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার জন্য। অথচ বর্তমানে এই হার যথাক্রমে প্রায় ৪৩ শতাংশ ও ১৬ শতাংশ—যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় অনেক বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি স্বরূপ।
স্টাফ লেভেল অ্যাগ্রিমেন্ট হয়নি, পরবর্তী ধাপে আলোচনা
সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চলতি দুই সপ্তাহব্যাপী পর্যালোচনার পর, যেমনটি পূর্বের কিস্তিগুলোর ক্ষেত্রে হয়ে আসছিল—একটি 'স্টাফ লেভেল অ্যাগ্রিমেন্ট' স্বাক্ষরিত হতো, যেটি মূলত পরবর্তী কিস্তির ছাড়ের বিষয়ে একটি প্রাথমিক চুক্তির প্রকাশ—এবার তা হয়নি। অর্থাৎ, এখনও পর্যন্ত কোনো ধরনের সমঝোতামূলক দলিল স্বাক্ষরিত হয়নি, যা থেকে বোঝা যায় আলোচনার পথ এখনও পুরোপুরি মসৃণ হয়নি।
এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও আইএমএফ জানিয়েছে, আলোচনা বন্ধ হয়নি এবং ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বসন্তকালীন বৈঠকে (২১-২৬ এপ্রিল) বিষয়টি ফের আলোচনায় আসবে। সেখান থেকে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
কর ব্যবস্থা, সুশাসন ও আইনি সংস্কারে জোর
সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফ আরও জানিয়েছে, বাংলাদেশে কর ব্যবস্থার সংস্কার এখন জরুরি। কর নীতি ও প্রশাসনের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য করতে হবে। করছাড় ও কর ফাঁকি রোধে নীতিগত ও প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া রাজস্ব আদায়ে টেকসই ও উদ্ভাবনী উপায় খুঁজে বের করাও সময়ের দাবি।
এ ছাড়া ব্যাংক খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আইনি সংস্কার ও সম্পদের মান যাচাই প্রক্রিয়া আরও কার্যকর করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা ও এর পরিচালন ব্যবস্থায় সুশাসন নিশ্চিত করার দিকেও গুরুত্ব দিয়েছে আইএমএফ।
আইএমএফ-এর মতে, শুধু ঋণ শর্ত পূরণ করাই নয়, বরং বাংলাদেশকে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন রোধে আরও দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে হবে। তারা মনে করে, এই খাতে জবাবদিহিতা ও বাস্তবায়নের ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা
৬ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এই মিশনে আইএমএফ প্রতিনিধিদল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে। বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ, বিইআরসি—সব প্রতিষ্ঠানই আলোচনায় অংশ নেয়।
এছাড়া অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গেও দু’দফায় বৈঠক করে মিশন দল। আলোচনায় প্রাধান্য পায় মুদ্রানীতির কাঠামো, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, বাজেট ঘাটতি ও অর্থনৈতিক টেকসইতা নিশ্চিত করার বিষয়গুলো।
ঋণ কর্মসূচির অগ্রগতি
উল্লেখ্য, আইএমএফ-এর সঙ্গে বাংলাদেশ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তিনটি কিস্তিতে মোট ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে। প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আসে ফেব্রুয়ারিতে, দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার আসে ডিসেম্বরে, এবং তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার আসে ২০২৪ সালের জুনে।
বাকি আছে আরও ২৩৯ কোটি ডলার। সরকারের আশা, এই জুনে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ একসঙ্গে ছাড় হবে। তবে তার জন্য দরকার হবে আইএমএফ-এর পূর্ণাঙ্গ সন্তুষ্টি এবং যেসব ক্ষেত্র নিয়ে উদ্বেগ আছে, সেগুলোতে দৃশ্যমান অগ্রগতি।
সার্বিকভাবে বলা যায়, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বাংলাদেশের আইএমএফ ঋণ কর্মসূচি কেবল অর্থায়নের নয়, বরং আর্থিক ব্যবস্থাপনার এক দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরের প্রক্রিয়াও। এই মুহূর্তে কিস্তি ছাড় আটকে থাকলেও, আশার কথা হলো আলোচনা এখনো চলমান এবং বন্ধ হয়নি। কিন্তু শর্ত পূরণ, বিশেষ করে খেলাপি ঋণ, কর ব্যবস্থাপনা ও সুশাসনে যদি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হয়, তাহলে আইএমএফ ভবিষ্যতে কিস্তি ছাড়ে আরও কঠোর হতে পারে। ফলে, আগামী মাসগুলো হবে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে এখনই নিতে হবে কার্যকর ও সাহসী পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ