
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনাময় একটি বিপ্লব আনতে চলেছে বে-টার্মিনাল প্রকল্প। দীর্ঘ সময় পর, অবশেষে এই প্রকল্পটির কাজ পুনরায় শুরু হচ্ছে, এবং আশার কথা, এ সপ্তাহে একনেক সভায় এর ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হতে পারে। একবার বাস্তবায়িত হলে এই প্রকল্প দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার জট কমাবে, যা বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকায় অবস্থিত সাগর উপকূল ঘেঁষে নির্মাণাধীন এই বে-টার্মিনাল, যা বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বড় হবে। এই প্রকল্পটির তিনটি অংশের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ১,৫০০ মিটার দৈর্ঘ্যের জেটি, সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি এবং ডিপি ওয়ার্ল্ডের জন্য প্রস্তাবিত ১,২২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের দুটি জেটি। প্রাথমিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটি সফল অংশীদারিত্ব তৈরি হবে, যা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান অবকাঠামো প্রায় ৪৫০ একর জায়গায় স্থাপিত, যার মাধ্যমে প্রতি বছর ৩০-৩২ লাখ কনটেইনার এবং ১২-১৫ কোটি টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং করা সম্ভব। তবে বর্তমানে এই পরিমাণ হ্যান্ডলিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় স্থল ও জলপথের গভীরতার অভাব রয়েছে। বর্তমানে, চট্টগ্রাম বন্দরের গভীরতা সাড়ে ৯ মিটার এবং বড় জাহাজের জন্য প্রায় ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত প্রবেশযোগ্য। কিন্তু বে-টার্মিনাল নির্মাণের ফলে এই পরিস্থিতি বদলে যাবে। এতে ১২ মিটার গভীরতা এবং ২৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের জাহাজও প্রবেশ করতে পারবে। এর ফলে, প্রতি বছর এই বে-টার্মিনাল হ্যান্ডলিং করবে প্রায় দেড় কোটি কনটেইনার এবং প্রায় ৫০ কোটি টন খোলা পণ্য, যা দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমকে বহু গুণ বাড়িয়ে দেবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এবং বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এই প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন নিয়ে আশাবাদী। তাঁরা বলেন, বে-টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের উপর চাপ কমবে। এটি বন্দর কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা আরও শক্তিশালী করবে এবং দেশের অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আনবে।
পরিকল্পনাটি প্রথম হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে, তবে জমি অধিগ্রহণ, নকশা, এবং অর্থায়ন সংক্রান্ত নানা জটিলতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটেছিল। ২০১৪ সালে জমি বরাদ্দের জন্য সিডিএর ছাড়পত্র পেতে দেড় বছর সময় লাগে, এবং পরবর্তীতে ২০১৭ সালে মাত্র ৬৭ একর জমি পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে আরও ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তবে প্রকল্পের পুরো কাজের জন্য এখনো প্রায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ বাকি রয়েছে।
এছাড়া, বিশ্বব্যাংক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ দেবে, যা প্রকল্পটির মূল কাজ শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন সরবরাহ করবে। বে-টার্মিনাল নির্মাণের পর, এটি চট্টগ্রাম বন্দরকে বিশ্বমানের সুবিধা প্রদান করবে, যাতে বাংলাদেশ তার বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে আসবে।
এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য পদক্ষেপ যেমন ট্রাক টার্মিনাল ও ডেলিভারি ইয়ার্ড নির্মাণও চলমান রয়েছে, যা আরও উন্নত পরিবহন অবকাঠামো নিশ্চিত করবে। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের চেহারা বদলে যাবে, এবং একটি আধুনিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে এই অঞ্চলটি নতুন করে সজ্জিত হবে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে বিপুল পরিবর্তন আসবে, তা দেশের জনগণের জন্য একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত হবে এবং বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ