
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার (এডিপি) বাস্তবায়নে গত ৯ মাসে গতি খানিকটা বেড়েছে, তবে পুরো বছরের শেষে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বড় ধরনের ঘাটতি হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা জানিয়েছেন। গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সরকার পরিকল্পিত এডিপির মাত্র ৩৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে, যা সরকারের অভ্যন্তরীণ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে শঙ্কা রয়েছে যে, পুরো বছরের শেষে লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা কম খরচ হতে পারে, ফলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থের অভাব দেখা দিতে পারে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি আরও কমে যেতে পারে।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগ সম্প্রতি জানায়, জুলাই-মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে এডিপির মোট ৮২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। গত বছরের মার্চ মাসে এই অর্থবছরের তুলনায় ২২ হাজার ৯ কোটি টাকা অর্থছাড় হয়েছিল, কিন্তু চলতি বছরের মার্চে তা মাত্র ১৫ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ, প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, যা এডিপির গতি কমে যাওয়ার একটি বড় সূচক। এই ধীরগতির প্রক্রিয়া পরিকল্পনার বাস্তবায়নে গভীর প্রভাব ফেলছে।
আইএমইডি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা খরচের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে প্রকল্পগুলোর বর্তমান বাস্তবায়ন হার এবং চলতি অর্থছাড়া পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে, বাকি তিন মাসে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড় হবে, যা মূল এডিপির লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক কম। এডিপির বাস্তবায়ন এখনও সেভাবে গতিশীল না হওয়ার কারণে, এই বছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ঘাটতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এদিকে, পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন আল রশিদ মনে করেন, প্রকল্পগুলোর ব্যয় কম হওয়ার পাশাপাশি শেষ সময়ে খরচ বাড়ানোর জন্য তাড়াহুড়া করা হলে অপচয়, দুর্নীতি এবং ব্যয়ের মানের অবনতি হতে পারে। তিনি বলেন, “উন্নয়ন কাজ অনেক স্থানে শেষ হলেও বিলগুলো এখনও দেওয়া হয়নি। একসঙ্গে তাড়াহুড়া করে টাকা খরচ করতে গেলে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং খরচের গুণগত মানও কমে যেতে পারে।” তিনি আরও যোগ করেন, “তাড়াহুড়া না করে, প্রকল্পগুলোর বিল যাচাই-বাছাই করে দেয়া উচিত।”
একইভাবে, বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, “এডিপি বাস্তবায়ন কম হওয়ার পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল ঠিকমতো অর্থছাড় না হওয়া এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বর্তমান সময়ে উন্নয়ন প্রকল্পে কম বরাদ্দ রাখা।” তিনি আরও বলেন, “জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তবে অন্যান্য প্রকল্পে কম খরচ করা হয়েছে।”
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে সরকার ৪৯ হাজার কোটি টাকা কাটছাঁট করেছে, কারণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের পক্ষ থেকে চাহিদা কম ছিল। সরকারি তহবিলের চাহিদা এত কম হওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি কমে যাওয়ার প্রতিফলন, এবং থোক বরাদ্দগুলোকে কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই কারণে, সরকার সংশোধিত বাজেটে থোক বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ২৬ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা রেখে দিয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
এদিকে, প্রাথমিক পর্যায়ে এডিপি থেকে আরো কাটছাঁট করা হয়েছিল, কিন্তু সংশোধিত এডিপি (আরএডিপি) অনুযায়ী, আসলে প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ কমানোর সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপির তুলনায় প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা কম বরাদ্দ করা হয়েছে। এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কম অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, যদি গত ৩ মাসে আরও ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকা অর্থছাড় করা হয়, তবে লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করা কঠিন হবে।
এছাড়া, সরকারের প্রকল্পের সিলিং (বাজেট সীমা) কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিদেশী ঋণ এবং অনুদান ব্যবহার করতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদিও সরকারি তহবিলের চাহিদা কম, তবে বিদেশী ঋণ এবং অনুদান থেকে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা চাহিদা দেওয়া হয়েছে। সরকার তার লক্ষ্য অনুযায়ী এসব অর্থায়ন ব্যবহারের চেষ্টা করছে, তবে সরকারের বিদেশী ঋণ ব্যবহার করার প্রবণতা প্রকল্পগুলোকে ঠিক সময়ে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করছে না।
এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং কম খরচ হওয়া সরকারের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যদি এই ধারা বজায় থাকে, তবে দেশের মোট আর্থিক উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অর্থনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন, নতুন প্রকল্পগুলো শুরু করা এবং পূর্ববর্তী প্রকল্পগুলো সম্পূর্ণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ