
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে বস্ত্র শিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সুতা। ভারত থেকে এই সুতা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস শিল্পের জন্য অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী উৎস ছিল। কিন্তু সম্প্রতি, বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের বিভিন্ন অংশে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে এবং এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা ও বিতর্ক।
ভারত থেকে সুতা আমদানির বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের একটি বড় অংশ ভারত থেকে সুতা আমদানি করে। প্রতিদিন বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ ট্রাক বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়, যার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ট্রাক সুতা হয়ে থাকে, যা গার্মেন্টস শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে গত ১৫ এপ্রিল থেকে ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এর ফলে বেনাপোল বন্দর দিয়ে সুতা আমদানির কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, যদিও অন্যান্য পণ্য আমদানি কার্যক্রম এখনও স্বাভাবিক রয়েছে।
স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা: বস্ত্র শিল্পের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর পক্ষ থেকে এই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে। বিটিএমএ দাবি করেছে, ভারতীয় সহায়তায় কম দামে সুতা রপ্তানি করে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করছে, ফলে স্থানীয় শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তাদের মতে, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ করা বাংলাদেশের স্থানীয় শিল্পের জন্য সুরক্ষা দেবে এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াবে। তারা মনে করে, ভারতের অত্যন্ত কম দামে সুতা রপ্তানি করায় বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় শিল্পের জন্য ক্ষতিকর।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য হুমকি
অন্যদিকে, নিট শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ জানিয়েছে, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "কম দামে সুতা পাওয়ায় ভারত থেকে আমদানি করা হয়। এখন, স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধ হলে, বিশেষ করে ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি সমস্যায় পড়বে।" তারা দাবি করেছে যে, ভারতে সুতা অত্যন্ত সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়, কিন্তু সমুদ্রপথ ও আকাশপথে আমদানি করা হলে তা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হবে।
বেনাপোল বন্দরের পরিস্থিতি
বেনাপোল বন্দর, যা বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর, এখানে ভারত থেকে সুতা আমদানির এই সংকটের ফলে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে কিছুটা পতন ঘটেছে। বেনাপোল বন্দরের পরিচালক শামিম হোসেন জানান, বর্তমানে ভারত থেকে সুতা আসছে না, তবে অন্যান্য পণ্য আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। তিনি আরও জানান, বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি না হওয়ায় বাণিজ্যিক কাজকর্ম কিছুটা থমকে গেছে।
সুতা আমদানি বন্ধের পেছনে সরকারের সিদ্ধান্ত
বিটিএমএ এবং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভারতীয় উৎপাদকরা অনেক দিন ধরে তুলনামূলক কম দামে সুতা রপ্তানি করে বাংলাদেশে কৃত্রিমভাবে বাজার দখল করে রেখেছে। বাংলাদেশ সরকার মনে করছে, এই পরিস্থিতির কারণে দেশের নিজস্ব শিল্পের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই, ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানির উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে যাতে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
ভবিষ্যত সম্ভাবনা
বিশ্ববাজারে সুতা ও টেক্সটাইল সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা, এবং এর সাথে সাথে দেশের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। তবে, সমুদ্রপথ ও আকাশপথে সুতা আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বাড়ার কারণে নিট শিল্পের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এই পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য সুতা সরবরাহের সুযোগ নিশ্চিত হয় এবং স্থানীয় শিল্পে নতুন করে প্রাণ ঢালা যায়।
ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের জন্য একাধিক সুফল ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। একদিকে, এটি দেশের স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করবে এবং উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা এর ফলে সমস্যায় পড়তে পারে, বিশেষ করে তাদের জন্য কম দামে সুতা পাওয়ার সুযোগ না থাকলে তাদের খরচ বৃদ্ধি পাবে। তবে, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাতে সকল স্তরের শিল্পের সমন্বিত বিকাশ সম্ভব হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ