
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব অর্থনীতির এক দুঃসাহসিক অধ্যায়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ, যেখানে মার্কিন শুল্ক নীতির ফলে একদিকে যেমন দেশটির প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক শিল্পের ওপর চাপ বেড়েছে, অন্যদিকে নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে একযোগে একাধিক দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, যা বাংলাদেশের জন্য এক ধরণের "গুড, ব্যাড, অ্যান্ড উগলি" পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এতে দেশটির পোশাক রপ্তানি, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় দিক, তা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তবে একই সঙ্গে বাংলাদেশের সামনে নতুন বাজারের সন্ধানও তৈরি হতে পারে, যদি দেশটি শুল্ক নীতির পরিবর্তন এবং বিশ্ববাজারে নতুন কৌশল গ্রহণে সক্ষম হয়।
শুল্ক নীতি এবং বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার
আমেরিকার শুল্ক নীতি থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির নতুন পথে পা রেখেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের আওতায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে হলে প্রতিটি দেশকেই অধিক শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। বিশেষভাবে এই নীতির মূল লক্ষ্য ছিল চীনসহ বিভিন্ন দেশকে শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তাদের বাণিজ্যিক আধিপত্য কমানো, এমনকি বিশ্ববাজারে নিজের দেশীয় শিল্পের প্রসারে সহায়ক ভূমিকা রাখা। এই পদক্ষেপের অন্যতম প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশে, যার প্রধান রপ্তানি পণ্য পোশাক।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম সরবরাহকারী, এবং দেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ মার্কিন বাজারে যায়। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বার্ষিক আয় ৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি, যার প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির আওতায়, এই শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এই শুল্ক, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের বাজারে ব্যয় বৃদ্ধি এবং গ্রাহকদের চাহিদা কমানোর সম্ভাবনা তৈরি করবে।
শুল্ক বৃদ্ধির পরিণতি এবং তা থেকে উদ্ভূত সংকট
প্রথমদিকে শুল্ক বৃদ্ধির পরিণতি দেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি বড় সংকট হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পর, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উপরে এই শুল্কের বিরূপ প্রভাব পড়বে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করতে বাংলাদেশকে অস্বাভাবিক শুল্ক দিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই শুল্ক ৫০ শতাংশের ওপরে চলে যায়, তবে বাংলাদেশের পোশাকের দাম অনেক বেড়ে যাবে, যা মার্কিন ক্রেতাদের জন্য আকর্ষণীয় হবে না।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য
অর্থনীতিবিদ ও পোশাক শিল্পের বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন শুল্ক নীতি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি শিল্পের জন্য একটি বড় বিপদ ডেকে আনবে। বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের অ্যাসোসিয়েশন 'বিজিএমইএ' এর প্রেসিডেন্ট, ফারুক হাসান বলেন, "আমাদের জন্য এটি একটি সংকট। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে, ফলে আমাদের রপ্তানি খরচও বাড়বে। এতে আমাদের ব্যবসা আরো চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।"
তিনি আরও বলেন, "শুল্ক আরোপের ফলে আমাদের বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে, এবং যদি বাংলাদেশ নতুন কৌশল গ্রহণ না করে, তবে তা আমাদের শিল্পের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।"
অন্যদিকে, পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, "আমরা যদি মার্কিন বাজারে প্রবেশ করার জন্য শুল্ক বহন করতে সক্ষম না হই, তবে আমাদেরকে বিকল্প বাজার খোঁজার পথে যেতে হবে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সস্তা শ্রম, এবং যদি আমরা আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও আধুনিক করি, তবে এই শুল্ক আরোপের প্রভাব কমানো সম্ভব হবে।"
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিআই) এর প্রেসিডেন্ট, মাহবুবুল আলম, এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, "এই শুল্ক আরোপ বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করে তুলবে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য এটি একটি বড় পরীক্ষার সময়। তবে, যদি আমরা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করি, তবে আমাদের জন্য নতুন বাজার খুলতে পারে।"
সুযোগ এবং কৌশলগত প্রস্তুতি
তবে শুল্ক নীতির কিছু সুবিধাও রয়েছে, বিশেষত যেসব দেশ মার্কিন শুল্ক নীতি থেকে মুক্ত থাকবে তাদের জন্য। বাংলাদেশ যদি চীন, ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে সস্তায় পোশাক সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, তবে কিছু সুযোগও সৃষ্টি হতে পারে। তবে এটি শুধুমাত্র তখনই সম্ভব, যদি বাংলাদেশ তার উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আধুনিক প্রযুক্তি এবং দক্ষতা উন্নত করে। উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু বাংলাদেশের শ্রম খরচ অন্যান্য দেশের তুলনায় কম, এটি বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। কিন্তু এই সুযোগগুলি পুরোপুরি কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশের সরকার এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পগুলোকে কিছু বড় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া, বাংলাদেশের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য আরও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। বর্তমানে দেশের পোশাক শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত, যা উন্নত দেশগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ার একটি কারণ। যদি বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদনে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতির প্রভাব কিছুটা কমানো সম্ভব হবে।
সরকারী পদক্ষেপ এবং আন্তর্জাতিক কৌশল
বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই শুল্ক নীতি প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করা। বিশেষত, সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কৌশল তৈরি করা, যাতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নতুন বাজার খোলা যায় এবং ক্রেতাদের নতুন মনোভাব তৈরি হয়। সরকারি স্তরে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে, যেমন বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য চুক্তি নবায়ন, নতুন রপ্তানি অঞ্চল খোলা, এবং সুষ্ঠু ও কার্যকর বাণিজ্য নীতি তৈরির দিকে মনোযোগ দেওয়া।
এছাড়া, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে অবস্থান শক্তিশালী করতে, সরকারের উচিত বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে রপ্তানি চুক্তি বৃদ্ধি করা। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের ব্র্যান্ডিং এবং স্বীকৃতি তৈরির জন্য বিভিন্ন প্রচারণা এবং ডিজিটাল মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করতে হবে।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ
সার্বিকভাবে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতির ফলে বাংলাদেশ একটি সংকটপূর্ণ অবস্থানে পড়েছে, তবে একই সঙ্গে কিছু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে, এই সুযোগগুলি কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ও কৌশলগত পরিকল্পনার প্রয়োজন। যদি বাংলাদেশ তার পোশাক শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং বিশ্ববাজারে তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করে, তবে শুল্ক যুদ্ধের পরিণতি দেশের জন্য একটি নতুন উত্সাহের রূপে আবির্ভূত হতে পারে।
পরিশেষে, বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের একটি মিশ্রণ রয়েছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির পরিবর্তনে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ