
ছবি: সংগৃহীত
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং ভয়াবহ তারল্য সংকটের প্রেক্ষাপটে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকারের অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল। নতুন অর্থনৈতিক নীতিতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে বিদেশি ঋণের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এ পরিবর্তন মূলত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে বিকল্প উৎস থেকে অর্থায়নের পথ তৈরি করতে বাধ্য করেছে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতা: কেন এই পরিবর্তন?
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাজেট অনুমোদনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। অন্যদিকে, বৈদেশিক ঋণ বাড়িয়ে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। অর্থাৎ, আগের তুলনায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বেশি বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাসে বড় পরিবর্তন
একই বৈঠকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূর্বঘোষিত ৬.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রাও ৬.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ৮ শতাংশেও মূল্যস্ফীতিকে ধরে রাখা কঠিন হবে, কারণ বাস্তবে এই হার এরই মধ্যে অনেকটাই ছাড়িয়ে গেছে।
বাজেটের আকার কমেছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা
বৈঠকে বাজেটের ব্যয় কাঠামোতেও ব্যাপক সংশোধন আনা হয়। মূল বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিগত সরকারের বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক প্রকল্প বাতিল করেছে। এতে বাজেট ব্যয়ে উল্লেখযোগ্য সাশ্রয় হচ্ছে।”
তিনি উদাহরণ দেন, “মেট্রোরেলে আগুন লাগার পর এর সংস্কারে বিগত সরকার ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সেটি মাত্র ১০ কোটি টাকায় সম্পন্ন করেছেন। এ ধরনের কার্যকর পদক্ষেপে বাজেট বাস্তবায়নে অপচয় রোধ সম্ভব হচ্ছে।”
বিদেশি ঋণে আগ্রহ বাড়ার পেছনে ইউনূসের ভূমিকা
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) একজন কর্মকর্তা জানান, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মানজনক অবস্থান আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। “তার নেতৃত্বে বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি গতানুগতিক তুলনায় বেড়েছে,” বলেন ওই কর্মকর্তা। এই আস্থা থেকেই বৈদেশিক ঋণকে বাজেটের মূল উৎস হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ব্যাংক ঋণ পরিস্থিতি
সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ব্যাংক ঋণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা ৯৯ হাজার কোটি টাকা হলেও এর মধ্যে জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ ইতোমধ্যেই গ্রহণ করেছে সরকার। এ থেকে ৪১ হাজার কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধের পর নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। উল্লেখযোগ্য হলো, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে সরকারের ঋণ গ্রহণ ছিল সর্বোচ্চ—এই দুই মাসেই প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, “ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধি দেড় লাখ কোটি টাকার বেশি হয়নি। অথচ সরকার ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিতে চেয়েছে। এতে বেসরকারি খাত চরম ঋণ সংকটে পড়ে যাবে। পাশাপাশি ডলার বাজারেও চাপ বাড়বে।”
রাজস্ব আদায়ের দুর্দশা
রাজস্ব আদায়ের বর্তমান পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা, যা বিগত দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম। কাস্টমস ডিউটি আদায় হয়েছে মাত্র ২৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র দেখা যাচ্ছে আয়কর আদায়ে—বর্তমানে এই খাত থেকে আদায় হয়েছে ৭৩ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা, যেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে একই সময়ে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এ কারণে সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা মূল লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার চেয়ে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা কম।
আইএমএফ চাপে রাজস্ব আহরণ
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, ঘোষিত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েই যেখানে সন্দেহ রয়েছে, সেখানে আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণ করতে হবে। এতে চাপ বেড়েছে এনবিআর কর্মকর্তাদের ওপর। এ অবস্থায় বাজেটে রাজস্ব খাত পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রবৃদ্ধি নয়, লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
অর্থ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার প্রবৃদ্ধি নিয়ে খুব বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, বরং মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অর্থনীতির গতি ধীর করে রাখাকেই লক্ষ্য করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে সংশোধিত বাজেটের মধ্য দিয়ে সরকার এক বাস্তবমুখী ও সংযত আর্থিক পরিকল্পনার দিকে এগিয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎসে চাপ কমিয়ে বিদেশি উৎসে আস্থা রাখার সিদ্ধান্ত যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি বর্তমান বাস্তবতায় তা একটি কার্যকর উপায়ও হতে পারে। তবে রাজস্ব আহরণের দুর্বলতা এবং ব্যাংক খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা—এই দুই ক্ষেত্রেই সুদূরপ্রসারী সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ