
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে সম্প্রতি চালের বাজারে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তার মূল সূত্রপাত হয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ধান মজুতের একচেটিয়া কর্মকাণ্ড থেকে। কৃষকের কাছ থেকে আমন মৌসুমে মনপ্রতি ১১০০ টাকায় ধান কিনে তা মাসের পর মাস ঘরে বা নিজস্ব ছোট গুদামে মজুত করে রেখেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তারা ধানের বাজারে মনপ্রতি ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকায় বিক্রির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ফলে কৃষকের হাত থেকে ধান উঠে যাওয়ার পর মিল পর্যায়ে সরবরাহ সংকট শুরু হয়েছে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলছে পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দামে।
রাজধানীর নয়াবাজার, মালিবাগ, রামপুরা ও জিনজিরার মতো প্রধান বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাসে মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৫-৭ টাকা বেড়েছে। স্বর্ণা জাতের মোটা চাল এক মাস আগে ছিল ৫৫ টাকা, এখন তা ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাইজাম ৬৫ টাকা, মিনিকেট কেজি ৯০-৯২ টাকা, আর নাজিরশাইল ৯৬ টাকায় ঠেকেছে। খুচরা বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের এই উচ্চমূল্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। যারা আগে মিনিকেট কিনতেন, তারাও এখন মোটা চালের দিকে ঝুঁকছেন।
এদিকে পাইকারি পর্যায়েও চালের বস্তায় ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির চিত্র দেখা গেছে। কাওরান বাজারের পাইকারি আড়তের মালিকরা জানান, এখন মোটা চালের (স্বর্ণা জাত) ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২৬৫০ টাকায়, যা এক মাস আগে ছিল ২৫৫০ টাকা। পাইজাম বস্তা ২৮০০ টাকা, আগে ছিল ২৭০০ টাকা। মিনিকেটের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে—এখন ৪৩০০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ৪১০০ টাকা। এক মাসে মিনিকেট বস্তায় ২০০ টাকার বৃদ্ধি। ঢাকার বাইরে নওগাঁ ও দিনাজপুর মিল এলাকাতেও একই চিত্র। মোটা চাল বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা, পাইজামে ৭০-১০০ টাকা এবং মিনিকেটে ২০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে।
খুচরা বাজারে চাল কিনতে আসা সাধারণ মানুষদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। মালিবাগ বাজারে মো. ইউসুফ বলেন, “চাল ছাড়া আমাদের চলে না। কিন্তু চালের দাম যদি ৯০ টাকা হয়, তাহলে অন্যান্য পণ্য কীভাবে কিনব?” মধ্যবিত্তরা এখন খাদ্য বাজেট কেটে অন্য খাতে ব্যয় করতে বাধ্য হচ্ছেন।
চালের এই অস্থির বাজার পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দিয়েছেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, “আমন মৌসুম শেষে চালের দাম ১-২ টাকা বাড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কৃষককে ন্যায্যমূল্য দিতে হবে, তা না হলে তারা চাষাবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।” তিনি আরও জানান, সরকার চলতি মৌসুমে বোরো ধান ৩৬ টাকা ও বোরো চাল ৪৯ টাকা দরে সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদ্দেশ্য হলো কৃষককে স্বাবলম্বী করা।
অপরদিকে সরকারি সংস্থা টিসিবি (ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ) এর হিসাবও দেখায়, মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২ টাকা। এক মাস আগে সর্বোচ্চ ৫৫ টাকায় বিক্রি হওয়া মোটা চাল এখন ৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বাস্তব বাজারদরে এই হিসাব অনেকটাই ব্যতিক্রম, বিশেষত খুচরা পর্যায়ে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের বাজারে নজরদারির ঘাটতি স্পষ্ট। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন বলেন, “বাজারে কেউ নজর রাখছে না। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা যেভাবে খুশি ধান মজুত করে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ নেই, ধানের উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি—তবু চাল কিনতে ৯০ টাকা গুনতে হচ্ছে।”
সরকার অবশ্য দাবি করছে, দেশে সরবরাহ সংকট নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভারতে বন্যার কারণে বাংলাদেশে আমন ধানের উৎপাদন কমেছে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন। এ ঘাটতি পূরণে ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম থেকে মোট সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে ৩ লাখ ৫৩ হাজার টন, মিয়ানমার থেকে ১ লাখ টন, ভিয়েতনাম থেকে ৮৪ হাজার টন এবং পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার টন চাল ইতোমধ্যে দেশে এসেছে। সরকারিভাবে ইউক্রেন ও আর্জেন্টিনা থেকে ২ লাখ টন গম আমদানির চুক্তিও বাস্তবায়ন হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৫০ হাজার টন গম দেশে এসেছে।
এছাড়া বাজারে আরও চালের সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে ১১ লাখ ৭৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৪৮ হাজার টনের বেশি চাল ইতোমধ্যে আমদানি হয়েছে। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি আমদানির মিলিত চিত্রে দেশে চাল বা গমের ঘাটতির কোনো বাস্তব কারণ নেই।
তবু বাজারে দাম বেড়েই চলেছে। কারণ, বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখন মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের কারসাজি ঠেকাতে সরকার যথাযথ নজরদারি না চালালে অস্থিরতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, এবং এর ক্ষতি ভোগ করবে সবচেয়ে বেশি নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগণ।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো—চাল বাজারে নজরদারি বৃদ্ধি, মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আমদানি চাল দ্রুত বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করা। না হলে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য দেওয়ার অজুহাতে বাজারে ধানের কারসাজি আরও বড় সংকটে রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ