
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ দ্বিবার্ষিক প্রতিবেদন ‘সাউথ এশিয়া ডেভেলপমেন্ট আপডেট: ট্যাক্সিং টাইমস’ প্রকাশ করেছে, যেখানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। এই পূর্বাভাস মূলত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আর্থিক চাপ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে সংশোধন করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায়, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা সঙ্কুচিত হয়েছে, এবং এর ফলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে ৫ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াবে, যা গত অক্টোবরে করা পূর্বাভাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ কম। তবে ২০২৬ সালে এটি কিছুটা বেড়ে ৬ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের জন্য এই পূর্বাভাসে নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, এবং নেপালের মতো দেশগুলির জন্য ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩ শতাংশে সীমাবদ্ধ হতে পারে, যদিও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি ৪ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, সেই পূর্বাভাসও কিছুটা কমানো হয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে, প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হবে।
বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য মূল ঝুঁকি রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং রাজস্ব সংগ্রহের ঘাটতি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর সংগ্রহের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার গড় সরকারি রাজস্ব ছিল গত পাঁচ বছরে জিডিপির মাত্র ১৮ শতাংশ, যেখানে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় ছিল ২৪ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজার বলেন, "এমন পরিস্থিতিতে, বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করা, কৃষি খাত আধুনিকীকরণ এবং বেসরকারি খাতকে আরও সক্রিয় করে তুলতে হবে।" এছাড়াও, তিনি ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ঘরোয়া রাজস্ব বাড়ানো এবং কর ব্যবস্থায় সংস্কারের কথা বলেছেন।
বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে, কর ব্যবস্থায় সংস্কার এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি, কর ফাঁকফোকর বন্ধ করা, কর বিধিমালা সরলীকরণ এবং কর অব্যাহতি হ্রাস করার জন্য একটি নীতি গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফগানিস্তানে আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাস পাওয়ায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে যাবে, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকেও কম। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি আরও কমে ২ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে। ভুটানে কৃষি খাতে দুর্বলতার কারণে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে, তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জলবিদ্যুৎ খাতে গতি আসায় প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হতে পারে।
নেপালে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্যা ও ভূমিধসের কারণে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়াবে, তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এটি ৫ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। পাকিস্তানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৩ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক আরও উল্লেখ করেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার আর্থিক দুর্বলতা এবং নিম্ন রাজস্ব রাজস্ব সংগ্রহে সমস্যা তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। বিশেষত, করোনার পরের সময় এবং অন্যান্য বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে অনেক দেশ তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সংগ্রাম করছে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান অর্থনীতিবিদ ফ্রানজিস্কা ওন্সর্জ বলেন, “নিম্ন রাজস্ব দক্ষিণ এশিয়ার আর্থিক দুর্বলতার মূল কারণ এবং এটি অনিশ্চিত বৈশ্বিক পরিবেশে স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।”
প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, কর ব্যবস্থায় সংস্কার, কর আদায়ে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কর অব্যাহতি হ্রাসের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা নিতে হবে।
বিশ্বব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির জন্য দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কার্যকর রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এবং শাসননীতি সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। বাংলাদেশ, ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর জন্যও কর ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে তারা উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে স্থিতিশীল এবং প্রবৃদ্ধিমুখী অর্থনীতি গড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ