
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থপাচারের মাধ্যমে দুবাইয়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। এদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ, উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা দুবাইয়ের অভিজাত এলাকায় গোল্ডেন ভিসার সুবিধা নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভিলা কিনেছেন।
এই চাঞ্চল্যকর অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একাধিক ধাপে অনুসন্ধান চালিয়ে এদের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৭০ জনকে চিহ্নিত করেছে, যারা দেশের বাইরে বিপুল অর্থ পাচার করে প্রপার্টি কিনেছেন। এদের সকলের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ই-টিআইএন) এবং কর রিটার্নসহ যাবতীয় আয়কর সংক্রান্ত নথি চেয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর কাছে অনুরোধ করেছে দুদক।
এই বিষয়ে দুদকের উপপরিচালক রাম প্রসাদ মন্ডল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, সন্দেহভাজন ৭০ জন ব্যক্তির আয়কর সম্পর্কিত তথ্যচিত্র বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা তারা বহির্বিশ্বে বিপুল সম্পদ অর্জন করলেও তা দেশে ঘোষণা করেননি বা উপযুক্ত উৎস দেখাতে পারেননি। চিঠিতে এসব ব্যক্তির সম্পদ কিনতে বিদেশি ব্যাংক, এমনকি সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থপাচার হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এই তালিকায় নাম রয়েছে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তির। তালিকাভুক্তদের মধ্যে রয়েছেন আহসানুল করীম, আনজুমান আরা শহীদ, হেফজুল বারী মোহাম্মদ ইকবাল, সৈয়দ রুহুল হক, গুলজার আলম চৌধুরী, ফারহানা মোনেম, সৈয়দ মিজান মোহাম্মদ আবু হানিফ সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে।
দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, “অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় দুদকের কর্মকর্তারা প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনো সংস্থার কাছে নথি তলব করতে পারেন। কমিশন কেবল প্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।”
এ ঘটনায় অনুসন্ধান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ছাড়াও এর আগে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টও ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এই অভিযোগ অনুসন্ধানে নির্দেশনা দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করে দুদক।
বিশ্বজুড়ে অর্থপাচার ও অবৈধ বিনিয়োগের তথ্য অনুসন্ধানকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (C4ADS) এবং ইউরোপীয় সংগঠন ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশি মালিক হয়েছেন ৯৭২টি সম্পত্তির। কাগজে-কলমে এসব সম্পদের আনুমানিক মূল্য ৩১৫ মিলিয়ন বা ৩১ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে ৬৪টি অবস্থিত দুবাইয়ের অভিজাত ‘দুবাই মেরিনা’ এলাকায়, এবং ১৯টি রয়েছে ‘পাম জুমেইরাহ’তে। উল্লেখযোগ্য যে, এই এলাকা দুবাইয়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং বিলাসবহুল আবাসিক অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। তথ্য অনুযায়ী, অন্তত ১০০টি ভিলা ও পাঁচটি আবাসিক ভবনের মালিক বাংলাদেশিরা। চার থেকে পাঁচজন বাংলাদেশি মিলে প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন, যদিও তাদের নাম তখন প্রকাশ করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত অর্থমূল্য কাগজে-কলমে দেখানো পরিমাণের চেয়েও অনেক বেশি, কারণ এসব সম্পত্তি কেনার সময় প্রকৃত দাম গোপন রাখা হয় এবং আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং চেইনের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, গত দুই বছরে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতে বাংলাদেশিদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি বাংলাদেশিরা এখন প্রোপার্টি কেনার দিক থেকে নেদারল্যান্ডস, চীন, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের মতো দেশের নাগরিকদেরও ছাড়িয়ে গেছেন।
এই তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক আগামীতে তালিকাভুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা ও সম্পদ জব্দের মতো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে। তবে সেটি সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত তথ্য ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের ওপর নির্ভর করবে।
বাংলাদেশ থেকে এই ধরনের অবৈধ অর্থপাচার কেবল দেশীয় অর্থনীতির জন্যই হুমকি নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে। ফলে দুদকের এই অনুসন্ধানকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাজনীতির ছত্রছায়ায় যারা অর্থপাচারের সুযোগ নিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনাই হবে রাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি এসব ব্যক্তি ছাড় পেয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অর্থপাচার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।
বাংলাবার্তা/এসজে