
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বব্যাংক তাদের পূর্বাভাসটি আবারও পর্যালোচনা করেছে এবং দেশটির অর্থনৈতিক উন্নতির আগের পূর্বাভাস থেকে বেশ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৩০ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে, যা আগের দুটি পূর্বাভাসের তুলনায় যথেষ্ট কম। এর আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবর এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের বৃহত্তম এই আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশ এবং ৪.১০ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছিল। তবে ২০২৫ অর্থবছরের জন্য প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৯০ শতাংশ হওয়ার কথা বলা হয়েছে, যদিও তা এখনও আগের পূর্বাভাসের তুলনায় কম।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কমানোর পেছনে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তা মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত জুলাই-আগস্টে অনুষ্ঠিত সরকারবিরোধী আন্দোলন এবং আগস্টে সরকারের রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটায়, যার ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে এবং এটি স্থিতিশীলতা অর্জন করতে না পারলে প্রবৃদ্ধির গতি আরও মন্থর হয়ে যেতে পারে।
বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে আরও জানিয়েছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য কিছুটা ইতিবাচক দিক হিসেবে কাজ করেছে। বিশেষ করে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবাহ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা হুন্ডির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে এবং ব্যাংকিং খাতে বৈদেশিক মুদ্রার দরের পার্থক্য কমে যাওয়ার কারণে সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমানোর কারণ
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমানোর আরেকটি বড় কারণ হলো রাজস্ব ঘাটতি এবং কর নীতি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশে কর হার তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও, রাজস্ব আদায়ের হার তা থেকে অনেক কম। দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গড় রাজস্ব আদায় ছিল জিডিপির মাত্র ১৮ শতাংশ, যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশে রাজস্ব আদায় একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলে সরকার মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়ার চিফ ইকোনমিস্ট ফ্রান্সিসকা ওহনসরগ বলেছেন, “রাজস্ব আদায়ের দুর্বলতা দক্ষিণ এশিয়ার আর্থিক সংকটের মূল কারণ।” করের হার বেশি হলেও, সঠিকভাবে রাজস্ব আদায় না হওয়ার কারণে সরকারের উপর করের চাপ বাড়ছে, যা দেশের সাধারণ জনগণের জন্য অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে।
মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক সংকট
বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে আরও জানায়, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি গড় হারে ৯.৩০ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে জুলাই মাসে এটি ১১.৭০ শতাংশে পৌঁছে ছিল, যা দেশের ভোক্তাদের জন্য ব্যয় সক্ষমতা হ্রাস করেছে। ফলে, ভোগব্যয়ের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমে গেছে। যদিও রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছুটা প্রবৃদ্ধি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃদ্ধি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে, তবে এটি অর্থনীতির মূল চাকা বেগবান করতে পারেনি।
বিশ্বব্যাংক আরও জানায়, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ালেও তা কার্যকরভাবে ব্যাংকিং খাতে পৌঁছাতে পারেনি। ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর উচ্চ অনাদায়ী ঋণ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, সরকারকে কয়েকটি ব্যাংককে নগদ সহায়তা দিতে হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ অবস্থা
বিশ্বব্যাংক শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক পূর্বাভাসও কমিয়েছে। ২০২৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে কমে ৫.৮০ শতাংশে নামতে পারে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভুটান, ভারত ও নেপাল কিছুটা উন্নতি লাভ করলেও, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ এবং শ্রীলঙ্কা এখনও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি।
বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছে যে, বাংলাদেশের জন্য সঠিক এবং কার্যকর অর্থনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু না হলে, দেশের অর্থনীতি আরও সংকুচিত হতে পারে। রাজস্ব সংগ্রহ, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন না করা গেলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব হবে না।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে বাংলাদেশের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং সুষ্ঠু অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ