
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ধীরগতি, মূল্যস্ফীতি ও কর্মসংস্থান হ্রাসের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
বুধবার প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমা অনুযায়ী (প্রতি দিন আয় ২.১৫ মার্কিন ডলারের নিচে), ২০২২ সালে বাংলাদেশের ৫ শতাংশ মানুষ অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতেন। কিন্তু ২০২৫ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে।
জাতীয়ভাবে হিসাব করা দারিদ্র্যের হার ২০২২ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো—বিবিএস)। বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা করছে, ২০২৪ সালের মধ্যেই এই হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। অর্থাৎ প্রায় ৪ শতাংশ পয়েন্টের বৃদ্ধি ঘটতে পারে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হান্স টিমার বলেন, “বাংলাদেশের অর্থনীতি একাধিক চাপের মুখে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সীমান্তবর্তী ও গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী।”
প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রমবাজারেও আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না থাকায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ করে যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত, তাদের আয়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। একইসঙ্গে খাদ্যদ্রব্য ও জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে গরিব মানুষের ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু আয় বাড়েনি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “আমাদের সমাজে যে ‘নিউলি পুওর’ বা নবদারিদ্র্যশ্রেণি তৈরি হচ্ছে, তারা খুব অল্প আঘাতে আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। সরকারের উচিত এখনই খাদ্য সহায়তা, নগদ ভাতা এবং কর্মসংস্থানমুখী প্রকল্প বাড়ানো, নয়তো সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।”
বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা আগের পূর্বাভাস (৪.১%) থেকেও কম। তবে আগামী অর্থবছরে এটি কিছুটা বেড়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য অপ্রতুল। আমাদের দরকার অন্তত ৬ শতাংশের ওপরে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি যাতে দারিদ্র্য হ্রাস পায় এবং কর্মসংস্থান তৈরি হয়।”
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চলমান মুদ্রাস্ফীতির চাপ এবং বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাড়তি ব্যয়ের কারণে সরকার উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দও সীমিত হয়ে পড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে দরিদ্রদের ওপর।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, “বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস সতর্কবার্তা হিসেবে নেয়া উচিত। সরকার ইতোমধ্যে সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী সম্প্রসারণ এবং কৃষি খাতে ভর্তুকি বাড়ানোর বিষয়ে কাজ করছে।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার যদি এখনই নীতি সংস্কার, প্রণোদনা এবং দরিদ্রদের জন্য লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক সহায়তা না বাড়ায়, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক দেশীয় প্রধান রবার্ট ওয়াটকিনস বলেন, “বাংলাদেশ অতীতে দারিদ্র্য হ্রাসে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ বাস্তবতায় সেই অর্জন ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি কাঠামোগত পুনর্মূল্যায়ন ও টার্গেটেড পলিসি এখন সময়ের দাবি।”
বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ দুটি—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক সুরক্ষা। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস কেবল সংখ্যা নয়, বরং একটি শক্তিশালী সতর্কবার্তা যে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে গেলে কেবল অর্থনীতি নয়, সামাজিক শান্তিও হুমকির মুখে পড়বে। সরকার, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা এবং বেসরকারি খাতকে সমন্বিতভাবে এই সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ