
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলমান অস্থিরতা ও আস্থাহীনতার প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগ কার্যক্রম ভয়াবহ মন্দার মুখে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক—দুই ধরণের বিনিয়োগেই এখন এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ সুদের হার, ডলার সংকট, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকট এবং দুর্নীতির সংস্কৃতির ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে দেশে নতুন কোনো বড় বিনিয়োগ আসছে না, বরং আগের অনেকগুলো উদ্যোগ থমকে গেছে কিংবা গুটিয়ে নেওয়ার পথে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মোট নেট বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। এর আগের বছর এ অঙ্ক ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে নেট এফডিআই কমেছে ২০.১৫ শতাংশ। শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদেশি বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ পরিস্থিতির দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশ্বব্যাংক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে অতিদরিদ্রের সংখ্যা বাড়বে ৩০ লাখ, যা মোট অতিদরিদ্রের সংখ্যা নিয়ে যাবে এক কোটি ৫৮ লাখে। জাতীয় দারিদ্র্যের হার বাড়বে ২২.৯ শতাংশে, যা বর্তমান ২০.৫ শতাংশের চেয়ে অনেক বেশি।
অর্থনীতিবিদ ড. বিরূপাক্ষ পাল বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপকভাবে খারাপ হয়েছে। সরকার অর্থনৈতিক সংকটের মূল জায়গাগুলোতে মনোযোগ না দিয়ে রাজনৈতিক ও আদর্শিক ইস্যুতে বেশি মনোযোগী হওয়ায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নতুন বিনিয়োগ থমকে গেছে, পুরনো অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে।’
বিনিয়োগকারীদের ভয় : গ্যাস-জ্বালানি সংকট, এলসি জটিলতা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে জটিলতা, ব্যাংকিং খাতের অনিশ্চয়তা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারিতে অতিরিক্ত কড়াকড়ি, এবং বারবার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে কারখানা পরিচালনায় অসহনীয় পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শুধু পুরনো কারখানাগুলোই নয়, নতুন উদ্যোক্তারাও শিল্প সম্প্রসারণ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিপুল সম্ভাবনা আছে। তবে সেটি কাজে লাগাতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অনেক পুরনো কারখানা গ্যাস পাচ্ছে না, নতুনদের ৩৩ শতাংশ বেশি দামে গ্যাস কিনতে হচ্ছে—এতে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।’
অর্থনীতিবিদ মামুন রশীদ বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। যখন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নিজেরাই অপেক্ষায় থাকেন, তখন বিদেশিরা কোনো সাহসে এগিয়ে আসবেন? বর্তমানে রিটার্ন অন ইকুইটি ১৩.৮৫ শতাংশ হলেও রিটার্ন অন অ্যাসেট মাত্র ০.৯৬ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নিচু অবস্থান।’
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মব সংস্কৃতি, বিনিয়োগের জন্য আতঙ্কের নাম
২০২৪ সালের নির্বাচনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ী মহলে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরবে এবং প্রশাসনিক স্থবিরতা কাটবে। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বরং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব কালচারের বিস্তার, বিদেশি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনাগুলো বিনিয়োগকারীদের আরও আতঙ্কিত করেছে।
এক বিনিয়োগ সম্মেলনের সময়ই দেশে ঘটে যাওয়া বাটা ও কোকা-কোলার মতো প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনাগুলো বিদেশি গণমাধ্যমে বড় করে প্রচার পায়। নিউইয়র্ক টাইমস তাদের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকির দেশ হিসেবে উল্লেখ করে। যদিও সরকার প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু সেই প্রতিবাদ ছাপা হয়নি। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা হারায়।
একজন বিশিষ্ট বাণিজ্য বিশ্লেষক বলেন, ‘বিদেশিরা যখন দেখেন বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে ব্র্যান্ডের কারখানা ভাঙচুর হয়, তখন তারা ভাবে, তাদের মালিকানার নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত? বিনিয়োগ তো শুধু অর্থ নয়, নিরাপত্তার গ্যারান্টিও।’
ব্যবসার খরচ, আমলাতন্ত্র ও করনীতির জটিলতা : কে এগোবে?
বাংলাদেশে ব্যবসার খরচ, বা ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ গত এক দশকে তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার দৌরাত্ম্য, করনীতির অস্বচ্ছতা ও বারবার বদল বিনিয়োগকারীদের পরিকল্পনায় বিঘ্ন ঘটায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ডলারের বাজারে অস্থিরতা ও টাকার অবমূল্যায়ন, যা বিদেশি ঋণের প্রকৃত খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এক শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক বলেন, ‘আমরা এখন কোনো বড় অর্ডার নিতে চাই না, কারণ কাঁচামাল আনতে গেলে এলসি খুলতে পারি না, ব্যাংক বলছে ডলার নেই। আবার যদি নিজ খরচে ডলার সংগ্রহ করে এলসি খুলি, তখন দাম পড়ে যায়। এতে লাভ তো হয়ই না, উল্টো লোকসান হয়।’
সরকারি বিনিয়োগেও গতি নেই, উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ কাটছাঁট
শুধু বেসরকারি বিনিয়োগ নয়, সরকারি খাতেও উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার কম। বরাদ্দকৃত অর্থও পুরোপুরি ছাড় হচ্ছে না। ফলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও দরিদ্র মানুষের আয়বর্ধক কার্যক্রমগুলো স্থবির হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতির ভবিষ্যৎ : দ্রুত সংস্কার ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার তাগিদ
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি সত্যিই ২০৩৫ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের উচ্চতর স্তরে যেতে চায় কিংবা সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ডের মত অর্থনৈতিক অবস্থানে পৌঁছাতে চায়, তাহলে প্রতিবছর ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, যা এখন পর্যন্ত কোনো দেশ করতে পারেনি।
তাদের মতে, ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ গঠনে অবকাঠামো উন্নয়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা, আমলাতান্ত্রিক সংস্কার, স্বচ্ছ করনীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে সমন্বিত কৌশল নিয়ে দ্রুত এগোতে হবে।
এক সিনিয়র ব্যাংকার বলেন, ‘যতক্ষণ না পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যাবে, ততক্ষণ অর্থনীতি এগোবে না। আস্থা গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং নীতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হবে।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারকে বিনিয়োগের পরিবেশ পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, নয়তো দারিদ্র্য ও বেকারত্বের যে ঢেউ ইতিমধ্যেই আঘাত হানছে, তা পুরো অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে দিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ