
ছবি: সংগৃহীত
২০২৫ সালের শেষভাগে, বিশেষ করে বড়দিন ও বছরের শেষের বিক্রয় মৌসুম পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর কাছ থেকে পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ পেয়েছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারকরা। ফলে আগামী কয়েক মাস দেশের শত শত পোশাক কারখানা ব্যস্ত সময় কাটাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে এই অর্ডার স্বস্তি দিলেও রয়েছে কিছু উদ্বেগ। মার্কিন বাজারে পোশাক রপ্তানির ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও তার ঘোষণার পর প্রাথমিকভাবে ৯০ দিনের জন্য এই শুল্ক বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়েছে, তবু এটি নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে জুন মাসের মধ্যেই ক্রয়াদেশ চূড়ান্ত হলেও পরবর্তী মৌসুমে কী হবে, তা নিয়ে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারক উভয়ই অপেক্ষা করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড়দিন ও থ্যাঙ্কসগিভিং উপলক্ষে পোশাক বিক্রির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম শুরু হয় সেপ্টেম্বর থেকে এবং চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ের জন্য তৈরি পোশাকের উৎপাদন শুরু হয় জুন মাস থেকে, যা জুলাইয়ের শেষ নাগাদ গতি পায় এবং আগস্টে শিপমেন্ট শুরু হয়। সে অনুযায়ী, বাংলাদেশের কারখানাগুলো এখন ব্যস্ত সময় পার করছে।
এই পরিস্থিতিতে টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, “আগামী বড়দিন পর্যন্ত অর্ডার নিশ্চিত আছে। তাই, আমরা এখন কোনো অনিশ্চয়তায় নেই। তবে দীর্ঘমেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতি যদি কার্যকর হয়, তাহলে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হতে পারে।” রাকিব জানান, তার প্রতিষ্ঠানের ৫৬০ মিলিয়ন ডলারের বার্ষিক রপ্তানির মধ্যে ২৫ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়।
তিনি আরও বলেন, “চীন থেকে সরিয়ে আমাদের কারখানায় ক্রয়াদেশ দিতে ইতোমধ্যে মার্কিন এক খুচরা বিক্রেতা এসেছেন। কারণ চীনের পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের ওপর সর্বোচ্চ শুল্ক ২৬ শতাংশ।”
বর্তমানে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ শুল্কহার ১০ শতাংশ, যার সঙ্গে অতিরিক্ত কিছু পণ্যে ১৬ শতাংশ শুল্ক যুক্ত হয়ে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত গড়ায়। অন্যদিকে চীনা পণ্যের ওপর শুল্কহার ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। যদিও ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, চীনের ওপর এই শুল্ক কমানো হতে পারে, তবে তা শূন্যে নামানো হবে না।
স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম জানিয়েছেন, তার বার্ষিক ৩০০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানির অর্ধেকই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। তিনি বলেন, “আমার কিছু মার্কিন ক্রেতা এখন ১০ শতাংশ সাধারণ শুল্কের অর্ধেক বহনের অনুরোধ করেছেন। তবে উৎপাদনের খরচের ৭০ শতাংশই তো কাপড় আমদানির পেছনে যায়।”
তিনি জানান, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে মার্কিন বাজারে বড়দিনের জন্য সব পণ্য পাঠিয়ে দিতে হবে। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক হুমকির কারণে এই মৌসুমে তার ক্রয়াদেশ গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ কমেছে।
প্যাসিফিক জিন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, “আমার মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে এখনো বড়দিনের চালান নিয়ে আলোচনা চলছে। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।”
রূপগঞ্জের এক গার্মেন্টস রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমার মার্কিন ক্রেতারা এখনো অর্ডার বাতিল করেননি, বরং স্থিতিশীলভাবে কাজ চলছে। তবে তারা কিছুটা দ্বিধায় আছেন এবং আগস্টের পরের সময় নিয়ে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন না।” তার রপ্তানির ৪০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রমুখী। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জুন মাসের মধ্যেই আগামী মৌসুমের অর্ডার নিশ্চিত হবে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “উচ্চ শুল্কের প্রেক্ষিতে ক্রেতারা হয়তো দর কমানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু রপ্তানিকারকদের দর কষাকষিতে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।”
বর্তমানে প্রায় ৯০০টির বেশি স্থানীয় গার্মেন্টস কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি করে। এদের মধ্যে ২৫টির মতো কারখানা মূলত মার্কিন বাজারে রপ্তানিকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরে কাজ করে থাকে। বাংলাদেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ, যার বাজারে ৯.৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। দেশটি বছরে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে।
এদিকে ইউরোপসহ অন্যান্য বাজারেও রপ্তানি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। কারণ ইউরোপে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে শুল্কমুক্ত সুবিধা। তবে এই বাজারেও চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কারণ তারাও মার্কিন বাজারে উচ্চ শুল্কের কারণে বিকল্প বাজার খুঁজছে।
এমন বাস্তবতায় আগামী দিনে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিকাশমান বাজারগুলোকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে শ্রম দক্ষতা ও পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়িয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করতে হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ