
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামে মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন হাউসের আড়ালে পাঁচটি দেশে কোটি কোটি টাকা পাচারের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে এক প্রভাবশালী দম্পতির বিরুদ্ধে। অভিযুক্তরা হলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর খালাতো ভাই মোহাম্মদ মামুন সালাম ও তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা।
অভিযোগ রয়েছে, ‘সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামের মোবাইল ব্যাংকিং ডিস্ট্রিবিউশন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন তারা। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের মুক্তিপণ আদায়ের ক্ষেত্রেও তাদের প্রতিষ্ঠানটি 'গেট কিপার' হিসেবে কাজ করেছে বলে অভিযোগ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
কীভাবে টাকা পাচার হয়েছে
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুবাই, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য আমদানির নামে দেশীয় ব্যবসায়ীরা সালাম ও কানিজের মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছেন বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়েছে। তবে বাস্তবে এসব পণ্যের একটি বড় অংশ দেশে আসেনি। মূলত আমদানির নামে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছে।
এ ছাড়া, সালাম-কানিজ দম্পতির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ই-মানিতে অর্থ রূপান্তর করা হতো। পরে নিয়ন্ত্রণাধীন এজেন্ট নম্বরের মাধ্যমে তা পাচারকারীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হতো। আর একটি বড় অংশ নগদ উত্তোলন করে ক্যাশে পাচার করা হতো। সিআইডির অনুসন্ধানে এসব তথ্যের সত্যতা মিলেছে।
মানি লন্ডারিং মামলার বিবরণ
২০২২ সালের ১৭ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে সিআইডি। এরপর ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়। মামলায় মামুন সালাম, তাঁর স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, টাকা পাচারকারী তানভীর হাসান ও তার বড় ভাই মালয়েশিয়া প্রবাসী সজল ইসলামসহ অজ্ঞাত পরিচয় আটজনকে আসামি করা হয়েছে।
সিআইডির তথ্যমতে, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত আড়াই বছরে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩৮ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য মিলেছে। তবে মন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় তখন তাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়নি বলে জানা যায়।
গণঅভ্যুত্থানের পর, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর, সিআইডি আনুষ্ঠানিকভাবে মামলাটি করে এবং পুরনো তদন্তের ভিত্তিতে বিষয়টি সামনে আনে। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগ।
কোন কোন দেশে টাকা পাঠানো হয়েছে
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, চীন থেকে মোবাইলসামগ্রী আমদানির নামে আল আমিন ৮ লাখ টাকা পাঠান, ওয়াজকুরুনী ৮ লাখ, ইলেকট্রনিক্স আমদানির নামে সোহেল রানা প্রায় ১০ লাখ, কম্পিউটার ও সফটওয়্যার পণ্যের আমদানির নামে মানিক চন্দ্র রায় ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠান।
তৈরি পোশাক, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিকস ও শিশুদের খেলনার আমদানির নামে নুরে আলম ভূঁইয়া পাঠান ২১ লাখ টাকা। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানির জন্য মোহাম্মদ কামাল ৫ লাখ এবং ব্যাগ ও মোটরপার্টস আমদানির নামে সাইদুর রহমান ১৬ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন।
এদিকে দুবাই থেকে স্বর্ণ আমদানির দাম পরিশোধে মোজাম্মেল হক হুমায়ূন পাঠান সাড়ে ৩৬ লাখ টাকা এবং ভারতে চিকিৎসার জন্য দোকান মালিক নাজমুল ইসলাম পাঠান ৬ লাখ টাকা। লিবিয়ায় মানব পাচার চক্রের মুক্তিপণ হিসেবে সাদিয়া সুলতানা ‘সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স’-এর ব্যাংকে জমা দেন ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
তানভীর হাসানও তার ভাই সজল ইসলামের কাছে একই চ্যানেলে দুই কিস্তিতে ১ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন, যা মালয়েশিয়ায় রিঙ্গিত হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে।
সিআইডির বক্তব্য
সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিন বলেছেন, “মানি লন্ডারিং মামলাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। আসামিদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। দেশের টাকা পাচারের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না।”
বিশ্লেষণ ও মন্তব্য
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মত সহজলভ্য প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে এভাবে অর্থপাচার প্রমাণ করে যে, দেশের আর্থিক খাতের মনিটরিং ব্যবস্থায় বড় ফাঁকফোকর রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং মনিটরিং সংস্থা (FATF) বারবার বাংলাদেশের মানিলন্ডারিং ঝুঁকি বাড়ার বিষয়ে সতর্ক করলেও, মাঠ পর্যায়ে নজরদারির ঘাটতি রয়ে গেছে।
একজন ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ বলেন, “যখন মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের আত্মীয়রা সরাসরি অর্থপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তখন ন্যায্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে দেশের আর্থিক খাতের ওপর আন্তর্জাতিক বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।”
আরেকজন মানবাধিকারকর্মী বলেন, “শুধু অর্থপাচার নয়, মানব পাচারের মুক্তিপণের টাকা পর্যন্ত যদি বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেন হয়, তাহলে এটি দেশের নিরাপত্তার জন্যও ভয়ংকর বার্তা বহন করে।”
একটি আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সংগঠিত এই অপরাধ চক্র মূলত সাধারণ ব্যবসায়ীদের ব্যবহার করেছে। তারা হয়তো জানতই না যে, আমদানির নামে টাকা দিয়ে তারা বড় অপরাধের অংশীদার হয়ে পড়ছেন।”
এখন প্রশ্ন হলো, যারা এতদিন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল, তাদের বিরুদ্ধে এই সরকার কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে? সাধারণ মানুষ এবং ব্যবসায়ীরা তাকিয়ে আছে সিআইডির তদন্তের ফলাফল এবং বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতার দিকে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি রক্ষায় এই মামলার দ্রুত এবং দৃষ্টান্তমূলক নিষ্পত্তি সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ