
ছবি: সংগৃহীত
প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা পূরণে ক্রমাগত আর্থিক সংকটে পড়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পেট্রোবাংলা এবার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেছে। এই ঋণকে 'নিরাপদ ঋণ' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে এবং মাত্র ০.২ শতাংশ মুনাফার শর্তে এক বছরের মেয়াদে এ অর্থ দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা চালাচ্ছে পেট্রোবাংলা, যা বর্তমানে ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি ছাড়িয়ে গেছে।
পেট্রোবাংলার ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা
বর্তমানে পেট্রোবাংলার উপর দেশি-বিদেশি সরবরাহকারীদের মোট বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ৪১৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এই বিপুল পরিমাণ দেনার মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক গ্যাস সরবরাহকারী (আইওসি), এলএনজি সরবরাহকারী এবং আন্তর্জাতিক ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএলসি)-এর ঋণ। শুধু এলএনজি আমদানির জন্যই বিশাল অঙ্কের আর্থিক দায়ভার নিতে হয়েছে পেট্রোবাংলাকে।
এর পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ও কর বাবদ দাবি রয়েছে ১৬ হাজার ৫৪৪ কোটি ২৪ লাখ টাকা। বিপুল দেনা এবং তারল্য ঘাটতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোবাংলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছিল, যা সরাসরি দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারত।
ঋণের প্রক্রিয়া ও শর্ত
বিপিসি এবং পেট্রোবাংলা উভয়ই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এই ঋণকে 'নিরাপদ' হিসেবে ধরা হয়েছে এবং এজন্য কোনো পেমেন্ট গ্যারান্টির প্রয়োজন পড়েনি। ঋণের চুক্তিতে প্রথম আট মাস গ্রেস পিরিয়ড দেওয়া হয়েছে, এরপর পরবর্তী চার মাসে মূল ঋণ এবং তার পরবর্তী তিন মাসে মুনাফা পরিশোধ করতে হবে পেট্রোবাংলাকে।
শর্ত অনুযায়ী, পেট্রোবাংলা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে অর্থদণ্ড দিতে হবে। এই ঋণের অর্থ কোনোভাবেই আইওসি ও এলএনজি সরবরাহকারীদের পাওনা ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না বলে চুক্তিতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
কেন প্রয়োজন হলো বিপিসির কাছে হাত পাতার?
পেট্রোবাংলার নিয়মিত রাজস্ব প্রবাহ ঠিক থাকলেও গ্রাহকদের বকেয়া পাওনার পরিমাণ অনেক বেশি। বিতরণ কোম্পানিগুলোর (তিতাস, বাখরাবাদ, কর্ণফুলী, জালালাবাদ, পশ্চিমাঞ্চল ও সুন্দরবন গ্যাস) কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহের বিপরীতে পেট্রোবাংলা বিশাল অঙ্কের অর্থ পায়নি। এর মধ্যে পিডিবি (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড), স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানি (আইপিপি) এবং বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন)-এর কাছেই বকেয়া রয়েছে প্রায় ২০ হাজার ৩৬২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
এর ফলে, এলএনজি আমদানির জন্য স্পট মার্কেট বা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় গ্যাস সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধে নিয়মিত বিলম্ব হচ্ছে, যার জন্য বিলম্ব সুদও গুণতে হচ্ছে পেট্রোবাংলাকে। এটি দেশের আন্তর্জাতিক বাজারে সুনামহানির কারণ হচ্ছিল এবং নতুন এলএনজি সরবরাহ চুক্তিতেও অনীহা তৈরি করছিল বিদেশি সরবরাহকারীদের মধ্যে।
কিভাবে সরবরাহ চলছে?
পেট্রোবাংলা বর্তমানে দেশি ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে ছয়টি বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে দেশে সরবরাহ করে। স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি (বিজিএফসিএল), সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) এবং বাপেক্সের মাঠগুলো থেকে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হয় ৭৩০-৭৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক দুই প্রতিষ্ঠান শেভরন ও তাল্লোর মাধ্যমে আসছে ১১৪০-১১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। পাশাপাশি আমদানি করা এলএনজি থেকে দৈনিক গড়ে ৮৩০-৮৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে দৈনিক ২৭০০ থেকে ২৭১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে।
সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪১ শতাংশ, সার কারখানায় যাচ্ছে ৫ শতাংশ, আর বাকি ৫৪ থেকে ৫৭ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে আবাসিক, শিল্প, বাণিজ্যিক এবং সিএনজি খাতে।
ঋণের চূড়ান্ত চুক্তি
চূড়ান্তভাবে ১৬ এপ্রিল বিপিসির ১০০৪তম পরিচালকমণ্ডলীর সভায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদিত হয়। পরে ২০ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ০.২ শতাংশ মুনাফার হার নির্ধারণ করে চূড়ান্ত চুক্তি হয়।
বিপিসির সচিব (সরকারের উপসচিব) শাহিনা সুলতানা জানান, ঋণের অর্থ সম্পূর্ণভাবে আইওসি ও এলএনজি সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধে ব্যবহৃত হবে। পেট্রোবাংলার অর্থ পরিচালক একেএম মিজানুর রহমান নিশ্চিত করেছেন, চুক্তির চেক ইতিমধ্যেই হাতে পেয়েছে পেট্রোবাংলা এবং দ্রুতই নগদায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
পেট্রোবাংলার তারল্য সংকটের মূলে রয়েছে ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের বকেয়া বিল আদায়ে দুর্বলতা এবং গ্যাসের সরবরাহ খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি। এই সংকট সামাল দিতে শুধু ঋণ গ্রহণ যথেষ্ট নয়, বরং বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দ্রুত বকেয়া আদায় এবং গ্যাসের দাম বাস্তবসম্মত করতে হবে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যথায়, ভবিষ্যতে আরও বড় আর্থিক সংকটে পড়তে পারে পেট্রোবাংলা এবং দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ