
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্যাটার্নে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসছে, আগামী বাজেটের আকার ছোট হতে যাচ্ছে, যা গত ৫৪ বছরে প্রথমবারের মতো আগের বছরের তুলনায় কমানো হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকুচিত মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকার এই সংকোচনমূলক বাজেট প্রস্তুত করছে, যা ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বর্তমান অর্থবছরের তুলনায় এই বাজেট প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। সরকার যখন ব্যয় সংকোচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এটি একদিকে যেমন জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে, অন্যদিকে তা কিছু খাতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে, বিশেষত কর সুবিধার ক্ষেত্রে।
বাজেটের আকার কমানোর পাশাপাশি সরকার বিভিন্ন শিল্পখাতে কর সুবিধা নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। এমন কিছু খাত আছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে কর অব্যাহতি বা কম কর হারের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে সরকার কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) সূত্রে জানা গেছে, আগামী বাজেটে কৃষি, মৎস্য, পোল্ট্রি এবং পোশাক খাতের কর সুবিধাগুলোর বিরুদ্ধে বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এসব খাতের জন্য যেসব কর অব্যাহতি বা কম হারের সুবিধা ছিল, তা উঠে যেতে পারে। এর ফলে ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, বিশেষ করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য এটি এক বড় ধাক্কা হতে পারে।
কর সুবিধার বাতিল ও তার প্রভাব
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে কর সুবিধার আওতায় রয়েছে, যেমন কৃষি, মৎস্য ও পোল্ট্রি খাত। এসব খাতে দীর্ঘদিন ধরে কর সুবিধা পাওয়া যাচ্ছিল, তবে এ বছর সরকারের পরিকল্পনা হলো, এই সুবিধাগুলো তুলে দেয়া হবে। এনবিআর জানায়, ২০১৫ সালে প্রান্তিক কৃষকদের সাহায্য করার জন্য এই কর সুবিধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু মন্ত্রী ও এমপিরা এর অপব্যবহার করেছেন, অনেকেই তাদের আয়কর নথিতে খামারের আয় দেখিয়ে সুবিধা নিয়ে আসছেন। তাই এই সুবিধাগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এছাড়া, পোশাক খাতও দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ কর সুবিধা ভোগ করছে। বর্তমান কর হার ১২ শতাংশ হলেও, এই খাতে কর হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। এই পরিবর্তনটির প্রভাব সরাসরি দেশের বৃহত্তম রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পে পড়বে। পোশাক শিল্পের কর হার ১৮ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে বাড়ানো হতে পারে, যা এই খাতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
পোশাক খাতের কর বৃদ্ধি: সংকটে আরও গভীরতা
দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্প ইতিমধ্যে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণে পোশাক খাত সংকটের মুখে পড়েছে। এর উপর যদি কর হার বাড়ানো হয়, তাহলে এই খাতের জন্য আরও বড় সংকট আসবে, এমনটাই মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
বিকেএমইএ (বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি) এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, "বাজেটে করপোরেট করহার বাড়ানো এ খাতের জন্য অবিচার হবে।" তার মতে, বর্তমানে ১২ শতাংশ কর দেওয়ার পরেও সরকারের অগ্রিম কর আদায়ের ফলে কার্যত উদ্যোক্তারা আরও বেশি কর পরিশোধ করেন। তার মতে, নতুন কর হার বাড়ানো হলে এটি ব্যবসায়ীদের জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হবে।
সরকার কর্তৃক একক কর মানদণ্ড এবং তার প্রভাব
বর্তমানে বিভিন্ন শিল্পের জন্য আলাদা আলাদা কর হার রয়েছে। এনবিআর কিছু কর হার একক মানদণ্ডে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছে, যা সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে একই হার আদায়ের প্রস্তাব দিতে পারে। এতে কিছু ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ হতে পারে, কিন্তু আয়ের ওপর করের হার কী হবে, তা এখনও নির্ধারণ হয়নি।
এছাড়া, অন্যান্য শিল্পের কর হারও একক মানদণ্ডে আনার পরিকল্পনা রয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় পরিবর্তন হতে পারে। তবে ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, এই একক হারে কর আদায় ব্যবসায়ীদের জন্য আরও বড় বোঝা হতে পারে, বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যখন তারা ইতিমধ্যে সংকটের মধ্যে আছেন।
ব্যক্তি করের প্রস্তাবনা এবং সমালোচনা
এনবিআরের পাশাপাশি, ব্যক্তি শ্রেণির করের দিকে সরকার মনোযোগী হয়েছে। বর্তমানে তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ে করমুক্ত সুবিধা রয়েছে, কিন্তু সরকার এবার এটি বাড়ানোর চিন্তা করছে না। সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ) এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্সসহ অন্যান্য সংস্থাগুলি ব্যক্তিগত কর হার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন, তবে সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যক্তিগত কর হার বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে না।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ন্যূনতম কর বাড়ানো উচিত হবে না। এর ফলে বৈষম্য সৃষ্টি হবে এবং এটি গরীব ও মধ্যবিত্ত জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।”
এছাড়া, সরকার জানাচ্ছে যে, সারাদেশে সবার জন্য একক ন্যূনতম কর নির্ধারণ করার চিন্তা রয়েছে, তবে এ বিষয়ে এখনও কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
বাজেটের মাধ্যমে কর সংস্কারের প্রস্তাবনা
অর্থনীতির শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সরকার কর সংস্কারের দিকে মনোনিবেশ করছে। তবে ব্যবসায়ীরা মনে করেন যে, এই সংস্কারগুলো যদি প্রয়োজনীয় সময় ও কার্যকর পরিকল্পনা না হয়ে থাকে, তবে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক হতে পারে। সিপিডি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এলডিসি (লিডিং ডিজাইনড কান্ট্রি) গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশের জন্য অনেক নতুন ধরনের নগদ সহায়তা আসবে, যা এই ধরনের কর সংস্কারের মাধ্যমে সরকার থেকে সঠিকভাবে প্রাপ্ত হতে হবে।
আগামী বাজেটের কর সংশোধন এবং সুবিধার পরিবর্তনগুলি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহলের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। বিশেষত পোশাক শিল্পের জন্য এটি একটি বড় সংকট তৈরি করতে পারে, যা ইতিমধ্যে নানা আন্তর্জাতিক সংকটে জর্জরিত। সরকার যে কর সুবিধা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়, কিন্তু এতে শিল্প খাতের উপরে যে চাপ পড়বে, তা অনস্বীকার্য। এর ফলে সরকারকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে এসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তেমন কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ