
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের শিল্পখাত বর্তমানে এক কঠিন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরবরাহের সংকট উৎপাদন প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। বিশেষত চট্টগ্রামের ছোট-বড় ইস্পাত এবং গার্মেন্টস খাতে এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। গত সাত মাসে অন্তত ৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং শতাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম থমকে রেখেছে। শিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো এবং সিস্টেম লসের কারণে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, যা ব্যবসায়িক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করছে।
গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি: উৎপাদন ব্যয়ে বাড়তি চাপ
২০২৩ সালে গ্যাসের দাম ১৭৮ শতাংশ বেড়েছে, যা শিল্পকারখানাগুলোর জন্য একটি বড় ধাক্কা। চলতি বছর, বিশেষত এপ্রিল মাসে, নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধির ফলে নতুন বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ থেকে বিরত হচ্ছেন, এবং পুরনো শিল্প মালিকরাও চাপে পড়েছেন। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি শুধু কারখানার উৎপাদন ব্যয়ই বাড়াচ্ছে না, বরং তাদের লাভজনকতা এবং প্রতিযোগিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শিল্প উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাসের সরবরাহ ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিরতি আসছে এবং যে কোনো কারখানা এক মিনিটের জন্যও বন্ধ রাখা সম্ভব নয়, বিশেষ করে ইস্পাত এবং গার্মেন্টস খাতে। এ ছাড়া, বিদ্যুতের দাম গত ১৪ বছরে ৯ বার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পাইকারি এবং গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি: পরিস্থিতি আরো খারাপ
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা এম শামসুল আলম মন্তব্য করেছেন, সিস্টেম লস না কমিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম একাধিকবার বাড়ানো হচ্ছে, যা একদিকে আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষতি করছে, অন্যদিকে শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি বন্ধ না করা হলে, প্রতিনিয়ত দাম বাড়ানোর চাপ গ্রাহকদের ওপর বাড়বে।
ইস্পাত ও টেক্সটাইল শিল্পের সংকট
ইস্পাত শিল্পের জন্য এই সংকট আরও গুরুতর। চট্টগ্রামে ইস্পাত উৎপাদনের শতকরা ৬২ ভাগ এবং ঢাকায় ৩২ ভাগ ইস্পাত কারখানা রয়েছে। এই ভারী শিল্পগুলো গ্যাস ও বিদ্যুতের উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। কেএসআরএমের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, গ্যাস এবং বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে অন্তত ২০ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে, খরচ বাড়ানোর পরও তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে পারছেন না, কারণ দাম বাড়ালে চাহিদা কমে যেতে পারে।
পোশাক শিল্পেও একই অবস্থা। গ্যাসের চাপ কম থাকলে টেক্সটাইল কারখানায় রঙের গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায় এবং বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের ফলে খরচ দ্বিগুণ হয়ে যায়। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে গত সাত মাসে অন্তত ৫০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিজিএমইএর মতে, এ সংকট থেকে উত্তরণ না হলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই বিপদগ্রস্ত হবে।
সার উৎপাদনে বিরতি
গ্যাস সংকটের কারণে চট্টগ্রামের রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিইউএফএল) উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। সিইউএফএল, যা প্রতিদিন ১,২০০ টন ইউরিয়া সার উৎপাদন করতে সক্ষম, গত ১৪ এপ্রিল থেকে গ্যাসের সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এতে দেশের সার উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা কৃষি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নতুন প্রতিষ্ঠানের সংকট
নতুন শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিরসরাইয়ের শিল্পনগরে গড়ে উঠতে যাওয়া অ্যালুমিনিয়াম ইনগট এবং কপার ইনগট তৈরির কারখানা, যা বাংলাদেশ-জাপান যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেই প্রতিষ্ঠানও এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি তাদের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। একইভাবে, চট্টগ্রামের আনোয়ারা শিল্প পার্কের ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পিছিয়ে যেতে পারে।
গ্যাস এবং বিদ্যুৎ খাতে যে সংকট চলছে তা দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ক্ষতি তৈরি করতে পারে। যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, তবে বাংলাদেশের শিল্পখাতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করা এবং পুরনো শিল্পকারখানাগুলোর কার্যক্রম চালু রাখা কঠিন হবে। সুতরাং, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, দ্রুত গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ স্থিতিশীল করা এবং দাম নিয়ন্ত্রণে আনা, অন্যথায় দেশের শিল্প খাত বড় ধরনের সংকটে পড়বে।
গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের শিল্পখাতে বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, নতুন বিনিয়োগ আসছে না, এবং পুরনো কারখানাগুলোর কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি, যাতে দেশের শিল্প খাত দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ