
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি সংকুচিত হতে শুরু করেছে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অব্যাহত মন্দার কারণে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো চাপের মধ্যে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরশাসন অবসানের পরেও অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। যদিও রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরেছে, তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের মন্দা পরিস্থিতি এবং কর্মসংস্থানের সংকট অব্যাহত রয়েছে। বিনিয়োগে মন্দাভাব, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গত এক বছরে দেশে বহু শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং হাজার হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। এর মধ্যে আবার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত, যার কারণে তারা বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, “এখনকার পরিস্থিতি বড় ধরনের ধাক্কা এনে দিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি এবং বিনিয়োগকারীদের মনোভাবের ওপর প্রভাব ফেলেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন এবং সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হতে পারে, সেটি নিয়ে তাদের শঙ্কা রয়েছে।”
বিশ্বব্যাংক তার প্রতিবেদন অনুযায়ী জানাচ্ছে, বাংলাদেশে চলতি বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। পাশাপাশি, আগামী ২০২৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৮ শতাংশে দাঁড়াতে পারে, যা পূর্ববর্তী পূর্বাভাসের তুলনায় শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ কম। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক আরও পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ৩০ লাখ মানুষ এই বছর অতি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে এবং দারিদ্র্যের হার ২২.৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা ২০২২ সালে ছিল ১৮.৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিশ্লেষক এবং অর্থনীতিবিদ ড. তানজিল আহমেদ বলেন, “দেশের অর্থনীতি সংকুচিত হওয়ার প্রক্রিয়া যদি অব্যাহত থাকে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। সরকারের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই সঙ্কট কাটানোর উপায় বের করা।”
মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত দুই অঙ্কের মধ্যে রয়েছে, এবং চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯.৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা সরকারের লক্ষ্য ৬ শতাংশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক বলছে, ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্র্যের হার আরও বাড়তে পারে। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৬.৫ শতাংশে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে এই ধারণা নিয়ে বিশ্বব্যাংক দ্বিমত প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ড. সিমা রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের উচিত সঠিক নীতি গ্রহণ করা, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তা কঠিন হবে।”
রাজস্ব ঘাটতি বিপুল পরিমাণে বেড়ে গিয়ে ৬৫,৬৬৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা বছরের শুরুতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক বেশি। বাজেট বাস্তবায়নও এক দশকের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে বাজেট বাস্তবায়ন ৮০ শতাংশের নিচে নেমে যাবে। অর্থনীতিবিদ ড. মো. সেলিম মিয়া বলেন, “এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। সরকারকে বাজেট বাস্তবায়ন এবং রাজস্ব সংগ্রহে দ্রুত পরিবর্তন আনতে হবে।”
ব্যাংক খাতেও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ঋণ অবলোপনের ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ঋণের মোট পরিমাণের ২০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে ১৭ শতাংশ বা ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা আদায় অযোগ্য খেলাপি ঋণ। ব্যাংকিং খাতের বিশেষজ্ঞ হাসান মাহমুদ বলেন, “এই পরিস্থিতি দেশীয় অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এটি ব্যাংক খাতের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে এবং ঋণ ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি করছে।”
অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায়, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিনিয়োগ থেকে বিরত রয়েছেন। দেশে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন না হওয়া, বিদেশি বিনিয়োগের অভাব, এবং ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি অর্থনৈতিক সংকটকে আরও প্রকট করেছে।
বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অনুমান করছে যে, সামনের বছরগুলোতে অর্থনীতির সংকোচন অব্যাহত থাকবে এবং এটি বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এই সংকট মোকাবিলায় দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ