
ছবি: সংগৃহীত
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ৩২ জন শিক্ষার্থী উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে আমরণ অনশন শুরু করেছেন, যা ক্রমেই একটি গভীর সংকটে রূপ নিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা এই অনশন কর্মসূচি থেকে সরে আসবেন না—প্রয়োজনে জীবন দেবেন। তাদের আন্দোলন কেবল একটি প্রশাসনিক পরিবর্তনের আহ্বান নয়; এটি এখন নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং শিক্ষার্থীদের মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
সোমবার (২১ এপ্রিল) বিকেল ৪টা থেকে কুয়েটের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের (SWC) বারান্দায় শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন শুরু করেন। রাতভর চলা এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা কোনো খাবার বা পানি না নিয়ে সেখানে অবস্থান করছেন। মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) সকাল পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অনশনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাহাত, তৌফিক, গালিব ও ওবায়দুল্লাহ জানান, কুয়েট প্রশাসনের ন্যায়বিচারহীন ও পক্ষপাতদুষ্ট আচরণেই তারা চূড়ান্তভাবে এই কর্মসূচি বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ভাষায়, “আমরা বারবার শান্তিপূর্ণভাবে দাবি জানিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। এবার জীবন দিয়েই হলেও আমাদের সম্মান ও নিরাপত্তার অধিকার আদায় করব।”
হামলা ও প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা
শিক্ষার্থীদের এই অনমনীয় অবস্থানের পেছনে রয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারির একটি সহিংস ঘটনা, যেখানে অভিযোগ অনুযায়ী, কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের নেতাকর্মী এবং বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, এ হামলার সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ধরনের কার্যকর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। পরে কুয়েট কর্তৃপক্ষ দায়সারা একটি মামলা দায়ের করে, যেখানে হামলাকারীদের নাম উল্লেখ না করে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ হিসেবে দেখানো হয়। এতদিনেও কারো বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
তাদের অভিযোগ আরও গুরুতর হয় যখন তারা উল্লেখ করেন, এই ঘটনার কিছুদিন পর এক বহিরাগত ব্যক্তি ২২ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। সে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো তদন্ত ছাড়াই ৩৭ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করে, যার মধ্যে অনশনরত শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, “প্রশাসন আমাদের রক্ষা তো করেইনি, উল্টো আমাদের শাস্তি দিয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”
হল দখল, দুর্বিষহ পরিস্থিতি
১৩ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা হল খুলে দেওয়ার দাবিতে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে তারা খোলা আকাশের নিচে দুই রাত কাটান। অবশেষে ১৫ এপ্রিল তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করেন। কিন্তু সেখানেও প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হন—খাবার, পানি ও ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের বেঁচে থাকার প্রাথমিক চাহিদাও উপেক্ষিত থাকে।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
এই পরিস্থিতিতে কুয়েট ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ ইলিয়াছ আক্তার জানান, “আমরা শিক্ষার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি, তারা যেন অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। আবারও গিয়ে কথা বলব।” তবে তার এই অবস্থান শিক্ষার্থীদের মনোভাব পরিবর্তনে এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
আন্দোলন আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এই আন্দোলন দিন দিন আরও তীব্র রূপ নিচ্ছে। শুধু অনশন নয়, অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসজুড়ে সংহতি প্রকাশ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হচ্ছে। অনেকে বলছেন, “এটি কেবল কুয়েট নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়।”
অনশনকারী ছাত্ররা এখন কেবল একটি প্রশাসনিক পদে পরিবর্তনের জন্য নয়, বরং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রতি দায়িত্বশীলতা, ন্যায়বিচার এবং সমান আচরণের জন্য তাদের জীবন বাজি রেখে দাঁড়িয়েছেন। এখন সময় প্রশাসন ও সরকারের জন্য—তারা কি এই অনশনকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নেবে, নাকি দীর্ঘায়িত করে আরো সংকট তৈরি করবে, সেটাই দেখার বিষয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ