
ছবি: সংগৃহীত
দেশের কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। কারিগরি ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের নেতৃত্বে এবার সারা দেশের সব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে অনির্দিষ্টকালের জন্য টানা শাটডাউনের ডাক দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) থেকে এই কর্মসূচি কার্যকর হচ্ছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাদের ছয় দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো ইনস্টিটিউটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকবে না।
শাটডাউনের ঘোষণা ও আন্দোলনের ধারাবাহিকতা
সোমবার (২৮ এপ্রিল) রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই শাটডাউন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তাদের উত্থাপিত ছয় দফা দাবির ভিত্তিতে বাস্তবায়নের রূপরেখা প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলবে।
এর আগে গত দুদিনে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের দাবির পক্ষে চাপ বাড়িয়েছে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিল, গণমিছিল, সমাবেশ এবং আইডিইবি কার্যালয়ে অভিযোগপত্র জমাদানের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি এরই মধ্যে পালন করা হয়েছে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেন, যার ফলে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়ে।
আন্দোলনের পটভূমি: ধাপে ধাপে উত্তেজনা
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি কয়েক মাসের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের ফল। ১৬ এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সাতরাস্তা মোড়ে বড় ধরনের বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। একই সময়ে মোহাম্মদপুর ও মিরপুরসহ দেশের বিভিন্ন শহরে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন। তীব্র যানজট ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হলেও শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ে অনড় ছিলেন।
এর আগে ১৫ এপ্রিল রাতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, যদি দাবি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ বা গড়িমসি হয়, তবে আন্দোলন ফের শুরু হবে — এবং বাস্তবে তাই হলো।
সরকারের উদ্যোগ ও শিক্ষার্থীদের অসন্তোষ
শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ ১৫ এপ্রিল বিকেলে অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিতে কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের একজন উপদেষ্টাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কমিটিকে তিন সপ্তাহের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করে মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
কমিটির নেতৃত্বে আছেন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব। সদস্য হিসেবে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) সাধারণ সম্পাদক, আইডিইবি সদস্যসচিব, সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাবিদের প্রতিনিধিরা।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, কমিটি গঠন করলেও বাস্তব অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, শুধু সময়ক্ষেপণ চলছে, বাস্তব কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
আন্দোলন আরো রূঢ় হয়
সরকারি পক্ষের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না রেখে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। তারা মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে গণমিছিল করেন, মশাল মিছিল করেন এবং পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোর নামফলক লাল কাপড়ে ঢেকে দেন। সর্বশেষ গত রোববার (২৭ এপ্রিল) শিক্ষার্থীরা জেলা পর্যায়ে সমাবেশ করে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। সেই সময়সীমা শেষ হতেই এবার সরাসরি শাটডাউনের ঘোষণা এল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক রদবদল
আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান খানকে সরিয়ে দেন। তার স্থানে উপাধ্যক্ষ শাহেলা পারভীনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্তকে আন্দোলনের সাফল্য মনে করলেও, মূল দাবিগুলো অনির্বাহিত থাকায় তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি কী?
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের প্রধান ছয়টি দাবি হলো:
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পেশাগত মর্যাদা ও চাকরির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা।
প্রকৌশল খাতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির ক্ষেত্রে অবিচার বন্ধ করা।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারে সমতা নিশ্চিত করা।
শিক্ষা কারিকুলাম যুগোপযোগী করা।
ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থা কার্যকর করা।
কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে আলাদা বাজেট বরাদ্দ এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামো উন্নয়ন।
বিশ্লেষক ও শিক্ষক নেতাদের মন্তব্য
কারিগরি শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের শিল্প ও উৎপাদন খাতের বিকাশে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তাদের চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় বৈষম্য দীর্ঘদিনের অভিযোগ। একজন শিক্ষক নেতা মন্তব্য করেন, "পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন শুধুই নিজেদের অধিকারের জন্য নয়; এটা পুরো দেশের শিল্পখাতের ভবিষ্যতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।"
আরেক বিশ্লেষক বলেন, "কারিগরি শিক্ষার অবমূল্যায়ন করলে দেশ দীর্ঘমেয়াদে দক্ষ জনবল হারাবে। সরকারকে দ্রুত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।"
সামনে কী?
শাটডাউন কর্মসূচি শুরু হওয়ায় দেশের ৪৯টি সরকারি ও প্রায় ৩৫০টির বেশি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলতি সেমিস্টারের ক্লাস ও পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সরকারের দ্রুত উদ্যোগ ছাড়া অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
শিক্ষামন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আন্দোলন সমাধানে আলোচনা চললেও শিক্ষার্থীদের চাপ বাড়ার কারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ