
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকাই চলচ্চিত্রের দর্শকের জন্য গত কয়েক বছরে একাধিক আলোচিত ও প্রতিশ্রুতিশীল সিনেমার ঘোষণা এসেছিল, যেগুলোর কাহিনি, অভিনয়শিল্পী বা প্রযোজনা ব্যয় নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিল। তবে নানা জটিলতা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, নির্মাণের অগ্রগতি থেমে যাওয়া কিংবা ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের কারণে এসব সিনেমা আজ অনিশ্চয়তার মুখে। কখনও মুক্তি পাবে কি না, আদৌ পর্দায় আসবে কি না—তা নিয়েই আজ প্রশ্ন।
নেত্রী : দ্য লিডার — অদৃশ্য গন্তব্যে অনন্ত জলিলের বহুল আলোচিত সিনেমা
২০২১ সালে বড় বাজেট, আন্তর্জাতিক কাস্টিং এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি সিনেমা দিয়ে দর্শকের সামনে হাজির হয়েছিলেন অনন্ত জলিল। নাম ‘নেত্রী : দ্য লিডার’, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়িকা বর্ষা। অনন্ত নিজে রয়েছেন বর্ষার দেহরক্ষীর ভূমিকায়।
দক্ষিণ ভারতীয় নির্মাতা উপেন্দ মাধবের পরিচালনায় নির্মিত এ সিনেমায় আরও যুক্ত হয়েছেন ভারতের পরিচিত মুখ—প্রদীপ রাওয়াত, কবির দুহান সিং ও তরুণ অরোরা। শুটিং হয়েছে প্রায় আশি ভাগ। অনন্ত ২০২3 সালে বলেছিলেন, বাকি ২০ ভাগ কাজ শেষ করে সিনেমাটি মুক্তি দেবেন ২০২৩-এর মধ্যেই। কিন্তু ২০২৪ পেরিয়ে ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালেও সিনেমাটি নিয়ে নেই কোনো নতুন খবর, নেই ট্রেলার, নেই মুক্তির তারিখ। দর্শক আর মিডিয়ার জিজ্ঞাসা—‘নেত্রী : দ্য লিডার’ কি আদৌ মুক্তি পাবে?
অপারেশন জ্যাকপট — রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু, আজ স্থবির
একটি ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌ-সেক্টরের দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযানের গল্পে তৈরি এ সিনেমা নির্মাণ করছেন ভারতীয় নির্মাতা রাজীব কুমার বিশ্বাস এবং বাংলাদেশের বর্ষীয়ান পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু।
প্রযোজক স্বপন চৌধুরী জানুয়ারিতে ২০২৪ সালে শুটিং শুরু করলেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনে সিনেমাটির কাজ একপ্রকার থমকে গেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েও এখন ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। সিনেমাটিতে অনন্ত জলিল ছাড়াও রয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, কাজী হায়াৎ, নিপুন, ইমন, নিরব, রোশান, মিশা সওদাগরসহ বড় একটি তারকাবহর।
এশা মার্ডার : কর্মফল — সত্য ঘটনা, অস্পষ্ট পরিণতি
একটি সত্য খুনের ঘটনা অবলম্বনে নির্মাণাধীন ‘এশা মার্ডার : কর্মফল’ সিনেমাটি নিয়ে শুরু থেকেই কৌতূহল ছিল। পরিচালনায় রয়েছেন সানী সানোয়ার। শুরুতে বলা হয়েছিল ২০২৪ সালের রোজার ঈদেই এটি মুক্তি পাবে। কিন্তু একাধিক তারিখ দিয়েও শেষ পর্যন্ত পর্দায় আসেনি সিনেমাটি।
এতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন ও পূজা ক্রুজ। সাসপেন্স ও রিয়েল-লাইফ ক্রাইম ঘরানার এই সিনেমাটির মুক্তি নিয়ে এখন আর কোনো খবর নেই, নির্মাতারাও আড়ালে চলে গেছেন।
ফুটবল ৭১ / ঠিকানা বাংলাদেশ — স্বাধীনতার গল্প, আজ নীরবতা
একাত্তরের স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের গল্প নিয়ে ‘ফুটবল ৭১’ নামে একটি সরকারি অনুদানের সিনেমা নির্মাণ শুরু হয়েছিল অনম বিশ্বাসের পরিচালনায়। তবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সিনেমাটির নাম বদলে রাখা হয় ‘ঠিকানা বাংলাদেশ’।
আরেফিন শুভ, নুসরাত ফারিয়া, ইরফান সাজ্জাদ, খায়রুল বাসার, বাধন লিংকনসহ তরুণ ও অভিজ্ঞ তারকাদের নিয়ে শুরু হওয়া এই সিনেমাটির কাজ কতটুকু শেষ হয়েছে, আদৌ কি তা পোস্ট-প্রোডাকশনে আছে—তা নিয়ে কোনো তথ্য নেই। সরকারি অনুদান পেয়েও সিনেমাটি আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে।
নূর — নির্মাতার মৃত্যুতে স্তব্ধ শুভ-ঐশীর সিনেমা
আরেফিন শুভ ও মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ঐশী অভিনীত ‘নূর’ সিনেমাটি নিয়ে একসময় তুমুল আলোচনা ছিল। পরিচালনায় ছিলেন জনপ্রিয় নির্মাতা রায়হান রাফি, প্রযোজনা করেছে শাপলা মিডিয়া। শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে, কিন্তু একাধিকবার মুক্তির ঘোষণার পরেও সিনেমাটি থমকে আছে।
২০২৪ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার গণপিটুনিতে নির্মাতা সেলিম খান ও তার ছেলে শান্ত খান নিহত হন। ফলে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কার্যত ভেঙে পড়ে। সে কারণে ‘নূর’ এখন প্রায় স্থবির, ভবিষ্যৎ নিয়েই রয়েছে ব্যাপক অনিশ্চয়তা।
নীলচক্র — আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দেশে মুক্তি অনিশ্চিত
আরেফিন শুভর আরেক আলোচিত সিনেমা ‘নীলচক্র’ যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডেন স্টেট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হলেও বাংলাদেশে এখনো মুক্তি পায়নি। পরিচালনায় রয়েছেন মিঠু খান, অভিনয়ে আছেন শুভ ও মন্দিরা চক্রবর্তী।
এই সিনেমা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ থাকলেও নির্মাতা কিংবা প্রযোজক মুক্তির বিষয়ে এখনো মুখ খোলেননি। দেশে রাজনৈতিক ও পরিবেশগত সেন্সর জটিলতা এড়াতে দেরি হচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
আগুন — চার বছরেও শেষ হয়নি শুটিং, শাকিব নিজেই বিরক্ত
নায়ক শাকিব খান ও জাহারা মিতু অভিনীত ‘আগুন’ সিনেমাটি ২০১৯ সালে ঘোষণা দিয়ে নির্মাণ শুরু করেছিলেন পরিচালক বদিউল আলম খোকন। আজ ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও সিনেমাটির একাধিক গানের শুটিংই এখনো হয়নি।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, শুটিংয়ের জটিলতা এবং প্রযোজনা ঘাটতিতে আটকে থাকা এই সিনেমার মুক্তি নিয়ে এখন শাকিব খান নিজেও বিরক্ত। তিনি নাকি নিজেই আর চান না সিনেমাটি মুক্তি পাক!
দিগন্তে ফুলের আগুন — শহীদ পরিবারের গল্প, থমকে গেছে নির্মাণ
শমী কায়সারের প্রযোজনায় এবং ওয়াহিদ তারেকের পরিচালনায় নির্মিত ‘দিগন্তে ফুলের আগুন’ সিনেমাটি শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালে। শহীদ সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার ও তার স্ত্রী পান্না কায়সারের জীবনের কিছু অধ্যায় উঠে আসবে এতে।
চিত্রনায়িকা বিদ্যা সিনহা মিম অভিনয় করছেন পান্না কায়সারের ভূমিকায়। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে এখনো সিনেমাটির নির্মাণের গতি পুরোপুরি থেমে গেছে।
ঢাকাই সিনেমার এই আলোচিত প্রজেক্টগুলো নানা সম্ভাবনা ও আলোচনা নিয়ে শুরু হলেও আজ তারা হারিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রযোজক পরিবর্তন, নির্মাতা সংকট কিংবা সামাজিক আন্দোলনের অভিঘাতে থেমে গেছে একাধিক সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্র।
এই সিনেমাগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে অনেক অনিয়ন্ত্রিত ফ্যাক্টরের উপর—সরকারি নীতি, বিনিয়োগকারীদের মনোভাব, সেন্সর ছাড়পত্র ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তবুও দর্শক এখনো আশায় রয়েছেন, হয়তো কোনো একদিন পর্দায় ফিরবে সেই প্রতীক্ষিত সিনেমাগুলো।