
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিনোদন অঙ্গনে এক সময় টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকগুলো ছিল দর্শকদের নিকট প্রধান আকর্ষণ। পরিবারভিত্তিক গল্প, চরিত্র নির্মাণের সময়সাপেক্ষ পরিক্রমা এবং ধাপে ধাপে নাটকীয়তা তৈরির মধ্য দিয়ে ধারাবাহিক নাটক একসময় দর্শক-মানসে গভীর দাগ কাটত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই জনপ্রিয় মাধ্যম যেন ধীরে ধীরে প্রান্তে সরে যাচ্ছে। বর্তমানে জনপ্রিয় তারকা শিল্পীদের অনাগ্রহ এবং দর্শক-রুচির পরিবর্তনের কারণে ধারাবাহিক নাটকের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তারকারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ধারাবাহিক থেকে
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় তারকা শিল্পীদের তালিকা করলে দেখা যাবে—মোশাররফ করিম, জাহিদ হাসান, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, আব্দুন নূর সজল, মেহজাবীন চৌধুরী, তাসনিয়া ফারিণ, তানজিন তিশা, ফারহান আহমেদ জোভান, নিলয় আলমগীর, তৌসিফ মাহবুব, কেয়া পায়েল, মুশফিক ফারহান, সাফা কবির, সাবিলা নূর প্রমুখ এখন ধারাবাহিক নাটকে আর আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এর পরিবর্তে তারা মনোযোগ দিচ্ছেন খন্ড নাটক ও অনলাইন কনটেন্টে—বিশেষত ওটিটি প্ল্যাটফর্মের নাটক বা ওয়েব সিরিজে। তারকাদের এমন মনোভাব শুধু ধারাবাহিক নাটকের প্রতি একটি সংকটই তৈরি করছে না, বরং এর ঐতিহ্য ও কনটেন্টের গুণগত মানকেও প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং পেশাগত অসন্তুষ্টি
অনেক অভিনয়শিল্পীর বক্তব্য অনুযায়ী, ধারাবাহিকে কাজ করে তারা অর্থনৈতিকভাবে সন্তুষ্ট নন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী বলেন, "একটি ধারাবাহিকে কাজ করে প্রতিদিন যে আয় হয়, তার তুলনায় অনলাইনের কাজ থেকে প্রায় তিন গুণ আয় করা যায়।" তার দাবি, অনেক সময় নির্মাতারা বাজেট কমাতে গিয়ে একদিনেই তিনদিনের কাজ করিয়ে নেন। তাড়াহুড়ো করে দৃশ্য ধারণ, সিডিউল ঝামেলা এবং মানসম্পন্ন গল্পের অভাব তাদের অনাগ্রহের মূল কারণ।
আরেকজন অভিনয়শিল্পী জানান, অনেক ধারাবাহিক নাটকে চিত্রনাট্য আগেভাগে গুছিয়ে দেওয়া হয় না, শুটিংয়ের সময়েই গল্প বদলে যায়। এতে একজন অভিনেতা নিজের চরিত্রে মনোযোগ দিতে পারেন না। অনেক সময় একটি নাটক দর্শকদের পছন্দ হলে হুট করে তার পর্ব বাড়ানো হয়, যা শিল্পীদের জন্য প্রস্তুতিহীনতার ঝুঁকি তৈরি করে।
প্রযোজকদের অভিযোগ: সময় দিচ্ছেন না শিল্পীরা
এদিকে প্রযোজকরা জানান, তারা চাহিদামতো পারিশ্রমিক দিয়েও তারকাদের শিডিউল পাচ্ছেন না। একজন প্রযোজক বলেন, "ধারাবাহিক নাটকের জন্য শিল্পীদের কাছে গেলেই অনেকে সরাসরি বলে দেন, তারা ধারাবাহিক নাটক করেন না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে এই মাধ্যম হারিয়ে যাবে।"
নস্টালজিক আবুল হায়াতের আক্ষেপ
ভVeteran অভিনেতা ও নির্মাতা আবুল হায়াত এ প্রসঙ্গে বলেন, "একসময় ধারাবাহিক নাটক পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চিত্র হয়ে উঠত। এখন শিল্পীরা অভিনয়কে পেশার চেয়ে ব্যবসা হিসেবে নিচ্ছেন। গল্পের প্রতি দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে। ফলে নাটকেও সেই আন্তরিকতা আর দেখা যায় না।"
মোশাররফ করিম ও জাহিদ হাসানের মতামত
মোশাররফ করিম বলেন, "অনলাইনের কাজের তুলনায় ধারাবাহিক নাটকে নির্মাতাদের যত্ন কম। এক দিনে ১৫-২০টি দৃশ্য ধারণ করতে হয়। গল্প গুছানো থাকে না, দ্রুত কাজ সেরে ফেলার প্রবণতা বাড়ছে।"
জাহিদ হাসান বলেন, "আগে ধারাবাহিকে কাজ করা সম্মানের বিষয় ছিল। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে সেই দায়বদ্ধতা নেই। অনেকে অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসার জায়গা হারিয়ে ফেলেছেন। কাজ বেছে নেন টাকার ভিত্তিতে।"
নাদিয়া, মেহজাবীন, ফারিণ ও জোভানের অভিজ্ঞতা
তবে সবাই ধারাবাহিক নাটক এড়িয়ে যাচ্ছেন না। অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ নিয়মিত ধারাবাহিকে কাজ করছেন। তার মতে, "যারা ধারাবাহিক করছেন না, তারা জনপ্রিয়তা বা রাতারাতি তারকা হওয়ার পেছনে ছুটছেন।"
মেহজাবীন বলেন, "ধারাবাহিকে নিজেকে প্রমাণের জায়গা কম, কারণ গল্পগুলো খুব সাদামাটা ও একঘেয়ে। খন্ড নাটকে নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তোলার সুযোগ বেশি থাকে।"
তাসনিয়া ফারিণ বলেন, "আমি যত পরিচিতি পেয়েছি, তা একক নাটক থেকেই। ধারাবাহিক নাটকের জন্য দীর্ঘ সময় দিতে হয়, যা এখন সম্ভব নয়।"
ফারহান আহমেদ জোভান জানান, "ধারাবাহিকে বারবার একই ধরনের চরিত্র করতে করতে একঘেয়ে লাগে। তাই খন্ড নাটকেই মনোযোগ দিয়েছি।"
চ্যানেলগুলোর ব্যবস্থাপনা ও বাজেট সংকট
নাট্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, চ্যানেল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থা ও বাজেট সংকট এ অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী। অনেক ক্ষেত্রেই ধারাবাহিক নাটক মানসম্মত নির্মাণের সুযোগ পায় না। নির্মাতারা বাধ্য হয়ে কম বাজেটে কাজ করেন, যা শিল্পীদের আগ্রহ কমিয়ে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে তারা অনলাইনভিত্তিক কনটেন্টের দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে স্বাধীনতা বেশি এবং দ্রুত সাড়া পাওয়া যায়।
ধারাবাহিক নাটক একসময় ছিল জাতির মনন ও সাংস্কৃতিক চর্চার অংশ। এখন সেই জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। তারকারা যেমন দায়ী, তেমনি প্রযোজক, নির্মাতা, চ্যানেল মালিক এবং দর্শকদেরও ভাবতে হবে—বাংলাদেশি ধারাবাহিক নাটকের ভবিষ্যৎ কেমন হবে। পরিবর্তন দরকার গল্পে, নির্মাণে, পেশাদারিত্বে এবং দর্শক-সম্পৃক্ততায়। নইলে একদিন হয়তো ধারাবাহিক নাটক শুধু স্মৃতির পাতায় ঠাঁই পাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ