
ছবি: সংগৃহীত
এক সময় ইংরেজি গানের জন্য জনপ্রিয় ছিলেন জেফার রহমান। সেই সময় তাঁর শ্রোতা ছিল নির্দিষ্ট একটি গণ্ডির ভেতরে সীমাবদ্ধ—বিশেষত ইংরেজি গানপ্রেমীদের মধ্যে। তবে সময়ের স্রোতে সেই গণ্ডি পেরিয়ে এখন জেফার হয়ে উঠেছেন সর্বজনবিদিত নাম। ‘ঝুমকা’ গানের মাধ্যমে বাংলা গানে পথচলা শুরু হলেও, আজকের জেফার এক ভিন্ন মাত্রার শিল্পী। শুধু কণ্ঠ দিয়েই নয়, অভিনয়, ফ্যাশন, স্টাইল এবং আত্মপ্রকাশের বৈচিত্র্যে এখন তিনি গুলশান থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত সব শ্রেণির দর্শক-শ্রোতার কাছে পরিচিত মুখ।
গানে-অভিনয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়া
জেফারের বর্তমান পরিচয় বহুমাত্রিক। একাধারে গায়িকা, অভিনয়শিল্পী এবং ফ্যাশন আইকন। সাম্প্রতিক ঈদুল ফিতরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দাগি’ চলচ্চিত্রে তাঁর গাওয়া ‘নিয়ে যাবে কি’ গানটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে বিপুলভাবে। গানটির কথা লিখেছেন বাঁধন, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন জেফার নিজেই, আর সংগীত পরিচালনা করেছেন মার্ক ডন। এ গানটির সাফল্য জেফারকে আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে মূলধারার বাংলা সংগীতে।
শুধু গানেই নয়, জেফারের অবস্থান এখন ওটিটিতেও সমান শক্তিশালী। শিহাব শাহীনের জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘মাইশেলফ অ্যালেন স্বপন ২’-এ বৈয়াম পাখি ২.০ গানে তাঁর উপস্থিতি ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। জেফার বলেন, “আমি তো গানের মানুষ, কিন্তু অভিনয়ে ভালো চরিত্র পেলে কখনো না করি না। এবার ঈদে সিনেমা আর ওয়েব কনটেন্ট—দুই জায়গাতেই কাজ করেছি। দর্শকদের যে রেসপন্স পেয়েছি, তাতে আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত।”
আমূল রূপান্তরের গল্প
জেফারের রূপান্তরটা ছিল একেবারেই নাটকীয়। যেখানে এক সময় তিনি ছিলেন চুলের বাহারি রঙ ও স্টাইলের জন্য আলোচনার কেন্দ্রে, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে তাঁকে সাদামাটা বাঙালি মেয়ের বেশে। এই পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে একটি সিনেমা—চরকি প্রযোজিত ‘লাস্ট ডিফেন্ডার অব মনোগামী’, যা নির্মাণ করছেন প্রখ্যাত নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। এই সিনেমার চরিত্রের জন্যই নিজের দীর্ঘদিনের চেনা লুক বদলান জেফার।
জেফার বলেন, “মনোগামী সিনেমার প্রস্তাব অনেক আগে থেকেই ছিল। কিন্তু নানা কারণে করা হয়নি। এবার ফারুকী ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি সেটা করতে পেরেছি। চরিত্রের জন্য এই রূপান্তর জরুরি ছিল। দর্শক ও পরিবারের সদস্যরা সবাই খুব প্রশংসা করছে। আমি তো অভিনেত্রী নই, এটা আমার প্রথম কাজ। তাই এত ভালো সাড়া পেয়ে আমি সত্যিই আপ্লুত।”
নিজের কাজেই আত্মবিশ্বাস
জেফারের প্রতি দর্শকের ভালোবাসা যেমন প্রবল, তেমনই কিছু সমালোচনাও তিনি পান—বিশেষ করে তাঁর ফ্যাশন স্টেটমেন্ট, গান কিংবা পারফরম্যান্স ঘিরে। তবে এসব সমালোচনায় খুব একটা পাত্তা দেন না তিনি। তাঁর ভাষায়, “গঠনমূলক সমালোচনা হলে আমি সেটিকে স্বাগত জানাই। কিন্তু ট্রল কিংবা নেতিবাচক কথাবার্তায় কান দিই না। কারণ এতে নিজের কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলি। আমি কেবল আমার কাজ দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করতে চাই।”
পথচলার শুরু এবং বিকাশ
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার তুলনায় সৃজনশীল কাজে বেশি আগ্রহী ছিলেন জেফার। বিশেষত সংগীত আর ফ্যাশনের প্রতি তাঁর টান ছিল প্রবল। ইংরেজি গান শুনে শুনেই তিনি গান শিখেছেন, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই। ২০১০ সালের দিকে ইউটিউবে ইংরেজি গান কভার করে ভাইরাল হয়ে ওঠেন। সেই সময়ই প্রথম আলোচনায় আসেন তিনি। তাঁর ইংরেজি একক অ্যালবাম তখনকার সময়ের তরুণদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।
এরপর আসে ‘ঝুমকা’ গান, যা তাঁকে বাংলা গানের জগতে আরও শক্ত অবস্থান এনে দেয়। এর পরপরই তিনি প্লেব্যাক করেন ‘ন ডরাই’ সিনেমায়। ইউনিক কণ্ঠ আর সাহসী ফ্যাশনের কারণে দ্রুতই দর্শকের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেন।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা
বর্তমানে জেফার একাধিক চলচ্চিত্র ও ওটিটি প্রজেক্টে কাজ করছেন। গানের পাশাপাশি অভিনয়েও নিজেকে নিয়মিত প্রমাণ করতে চাইছেন তিনি। তাঁর ভাষায়, “আমি চাই এমন কিছু চরিত্র করতে, যেখানে সত্যিকার অর্থে অভিনয়ের গভীরতা থাকবে। একইভাবে চাই গানেও আমার প্রতিটি কাজ আলাদা হোক, অর্থবহ হোক।”
তিনি আরও বলেন, “ভবিষ্যতে শুধু সংগীতশিল্পী বা অভিনেত্রী হিসেবে নয়, আমি চাই নিজেকে এমন একটি পূর্ণাঙ্গ বিনোদনমাধ্যমের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে, যেখানে আমার প্রতিটি কাজ দর্শকদের মনে ছাপ ফেলবে।”
সব মিলিয়ে, জেফার এখন আর শুধুই কোনো নির্দিষ্ট শ্রোতার শিল্পী নন। তিনি এখন সবার—সাধারণ মানুষের, তারুণ্যের, ফ্যাশনপ্রিয়দের, গানের প্রেমিকদের, এমনকি সিনেমার দর্শকদেরও আপনজন হয়ে উঠেছেন। যে যেভাবেই দেখুক, একথা বলতেই হয়—এই জেফার এখন সবার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ