
ছবি: সংগৃহীত
ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাস এক গৌরবময় পথচলার পাশাপাশি এক দুঃখগাথারও সাক্ষী। প্রতিভা, মেধা আর পরিশ্রমের ফসল হওয়ার কথা ছিল যে ইন্ডাস্ট্রির, সেখানে আজও ভেতরে ভেতরে চলে ভয়ংকর রাজনীতি—ফিল্ম পলিটিক্স। এর শিকার হয়ে হারিয়ে গেছেন বহু প্রতিভাবান তারকা। অনেকেই সময়ের আগে ঝরে গেছেন, কেউ প্রাণও হারিয়েছেন। এই ফিল্ম পলিটিক্সের কারণে নষ্ট হয়েছে অগণিত স্বপ্ন। বাংলা সিনেমার উঠতি তারকাদের হারিয়ে যাওয়ার পিছনে যে নিষ্ঠুর রাজনীতির অবদান আছে, তা আজ আর গোপন কোনো বিষয় নয়।
সিনেমার রাজনীতির কালো ছায়া বাংলা চলচ্চিত্রের শুরু থেকেই ছিল বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। অনেকে তো সরাসরি বলেন—‘জাতীয় রাজনীতির চেয়েও ঢালিউডের রাজনীতি ভয়ংকর!’ সময়ের আবর্তে এ চিত্র শুধু আরও ভয়াবহ হয়েছে। আজকের প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে সেইসব তারকাদের গল্প নিয়ে, যাদের ক্যারিয়ার ও জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে ফিল্ম পলিটিক্সের কালো থাবা।
চম্পা: মেধাবী অভিনেত্রীও রক্ষা পাননি
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সুন্দরী ও মেধাবী অভিনেত্রী গুলশান আরা চম্পা। প্রথম চলচ্চিত্র ‘তিনকন্যা’ দিয়েই নজর কাড়েন তিনি। একের পর এক দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। অথচ এমন একজন অভিনেত্রীকেও থমকে যেতে হয়েছে নোংরা রাজনীতির কারণে। এক সাক্ষাৎকারে চম্পা নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি রাজনীতির শিকার হয়েছি। কেন হয়েছি—তার উত্তর এখন আর খুঁজে বেড়াই না।’ তার এ বক্তব্য আজও চলচ্চিত্রের ভিতরকার নির্মম সত্যকে সামনে আনে।
সোহেল চৌধুরী: প্রতিভার মাশুল মৃত্যু
সোহেল চৌধুরী—এক সম্ভাবনাময় নায়ক, যার জীবন থেমে যায় নির্মম হত্যাকাণ্ডে। দিতির সঙ্গে সংসার জীবনে প্রবেশের পরও ক্যারিয়ার উড়তে পারেনি। অনেকে বলছেন, ইন্ডাস্ট্রির একশ্রেণির অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও চক্রান্তই তার অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ মৃত্যু নিয়ে এখনো আফসোস করেন।
সালমান শাহ: এক ধূমকেতুর পতন
'৯০ দশকের শ্রেষ্ঠ নাম সালমান শাহ। অল্প সময়ে যে জনপ্রিয়তা, তা বিরল। কিন্তু তার দ্রুত উত্থান সহ্য হয়নি অনেকের। বারবার কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়। সালমান শাহ নিজেও সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিলেন। এরপর রহস্যজনকভাবে তার মৃত্যু। আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে প্রশ্ন—আত্মহত্যা নাকি পরিকল্পিত হত্যা?
শাকিল খান: সম্ভাবনার অপমৃত্যু
সালমান শাহের পরে যিনি আসতে পারতেন ঢালিউডের একচ্ছত্র নায়ক হয়ে—তিনি শাকিল খান। কিন্তু গুঞ্জন, রাজনীতি ও চরিত্র হননের কারণে হারিয়ে যেতে হয় তাকেও। সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে যায় সিনেমার অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে।
পপি: নির্যাতিত প্রতিভা
পপি, এক সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা। ক্যারিয়ারের মধ্যগগনে থাকা অবস্থায় হঠাৎই তিনি হারিয়ে যান। পপি প্রকাশ্যে অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘নায়ক এবং শিল্পী নেতার নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছি।’ ইঙ্গিত ছিল শাকিব খানের দিকেই। অনেকেই বিশ্বাস করেন, পপির ক্যারিয়ার নষ্ট করার নেপথ্যে ছিল শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
আমিন খান: প্রতিভা চাপা পড়ার গল্প
নব্বই দশকের ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রতিযোগিতা দিয়ে উঠে এসেছিলেন আমিন খান। কিন্তু তার ক্যারিয়ার আটকে যায় দুই বছর শুধু মাত্র ফিল্ম পলিটিক্সের কারণে। আমিন খান বলেন, ‘অনেক নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছি। হতাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলাম।’
পূর্ণিমা: নীরব শিকার
ব্যবসাসফল সিনেমার নায়িকা পূর্ণিমাও চুপচাপ রাজনীতির শিকার হন। একাধিক সিনেমা থেকে বাদ পড়তে হয় তাকে। পূর্ণিমা এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সিনেমা কমে আসছে, বেকার হচ্ছে শিল্পীরা—সবকিছুর মূলে পলিটিক্স।’
শাকিব খান: শিকার এবং পরে অভিযুক্ত
নিজেই এক সময় ফিল্ম পলিটিক্সের শিকার হয়েছিলেন শাকিব খান। কিন্তু পরে অভিযোগ উঠেছে, শাকিব ক্ষমতায় গিয়ে অন্যদের কাজের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। নতুন নায়কদের অনেককেই তার প্রভাবে কাজ থেকে বাদ পড়তে হয়েছে—এমন অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই।
আঁচল আঁখি: হতাশার চরম পর্যায়
আঁচল আঁখি, যিনি সম্ভাবনার আলো ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু চুক্তিবদ্ধ হয়েও একাধিক সিনেমা থেকে বাদ পড়েন। আঁচল বলেছিলেন, ‘চুক্তির পরও বলা হতো, আর কাজ নেই, অন্য কাউকে নেওয়া হয়েছে।' ফেরত দিতে হতো সাইনিং মানি!
জিনাত সানু স্বাগতা: অভিমান নিয়ে বিদায়
নাটক থেকে সিনেমায় যাত্রা শুরু করেন স্বাগতা। মান্নার বিপরীতে কাজ করে জনপ্রিয়তা পান। কিন্তু উত্থান শুরু হতেই ফিল্ম পলিটিক্সের শিকার হন। স্বাগতা বলেন, ‘অনেকবার চক্রান্তের শিকার হয়েছি, তবুও চুপ থেকেছি।’
তমা মির্জা: সম্ভাবনায় থাবা
তমা মির্জা যখন সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছিলেন, তখনই বন্ধুর পথ তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘আমি নতুন ছিলাম, সুযোগ দেওয়া হতো না। ফিল্ম পলিটিক্সে বারবার পিছিয়ে যেতে হয়েছে।’
পূজা চেরী: তরুণ প্রজন্মের হতাশা
বর্তমান সময়ের অন্যতম আলোচিত অভিনেত্রী পূজা চেরীও বলেছিলেন, ‘ভালো জিনিসের কদর নেই। নিজেদের সিনেমা নিজেরাই শেষ করছি।’ পূজার এই বক্তব্য সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান করুণ অবস্থার প্রতিচ্ছবি।
দীঘি: নিষ্ঠুর সিন্ডিকেটের শিকার
শিশুশিল্পী দীঘি আজ একজন নায়িকা। কিন্তু গত তিন বছর ধরে ফিল্ম পলিটিক্সের যন্ত্রণা সহ্য করছেন বলে অভিযোগ তার। দীঘি বলেন, ‘এই ইন্ডাস্ট্রির লোকেরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষ্ঠুর।’
সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে লড়াই অসম
বাংলা চলচ্চিত্রে টিকে থাকার জন্য শুধুমাত্র প্রতিভা, দক্ষতা বা ভালো কাজ যথেষ্ট নয়—এটাই আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। একটা বড় অংশের অভিযোগ, যারা সিন্ডিকেটের বাইরে থাকে, তাদের জায়গা হয় না। নায়ক-নায়িকাদের ক্যারিয়ার ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যার কারণে সিনেমার মানেরও অবনতি ঘটছে দিনকে দিন।
আজকের ঢালিউডে যারা টিকে আছেন, তারাও বলছেন—'একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী ইন্ডাস্ট্রি নিয়ন্ত্রণ করছে। যারা তাদের সঙ্গে যায় না, তারা হারিয়ে যায়।’
বাংলা সিনেমার ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে এই নোংরা রাজনীতির অবসান জরুরি। না হলে আরও অগণিত প্রতিভা হারিয়ে যাবে ইতিহাসের আড়ালে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ