ছবি : সংগৃহীত
ভ্রমণ নিছক বিনোদনের উপকরণ বা ঘোরাঘুরির অভিলায় নয়, বরং আত্মজ ও আত্মার অকৃত্রিম খোরাক। বিষাদিত হৃদয় ফুরফুরে করতে কখনো কখনো ভ্রমণ অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় রূপ নেয়। ভ্রমণপিয়াসী মানুষ ভ্রমণের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে। পৃথিবীর আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রবের সৃষ্টিরহস্য দেখার আনন্দই অন্যরকম।
সৃষ্টির রহস্যময় এই পৃথিবীকে ঘুরেফিরে দেখার জন্য মন হয়ে আছে উচাটন। মানুষ আজকাল বিভিন্ন রিসোর্টে হানিমুনে যেতে অথবা অর্থবিত্তের বলয়ে জীবনের অভিলাষে এসবের মধ্যে সময় কাটাতে পাগলপারা, অথচ মহান রব তার নিদর্শনাবলি স্বচক্ষে অবলোকন করে শিক্ষাগ্রহণ করতে আদেশ করেছেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে। অপাত্রে টাকা খরচের গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন করা অপরিহার্য হয়ে গেছে ভ্রমণের নামে অহেতুক টাকা খরচান্তদের। জীবনের গভীরে যেতে অবশ্যই ভ্রমণ নামক সমীরণের খুবই প্রয়োজন। গভীরতা, অভিজ্ঞতা, নিবিষ্টতা— জীবন চলার পথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আর এগুলো ভ্রমণের মাধ্যমে পূর্ণতা পায়।
আমার জীবনে ভ্রমণের উপাখ্যান নামমাত্র বললেই চলে। ভ্রমণপিয়াসী হয়েও ভ্রমণ করতে না পারার মনোদুঃখ আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায় প্রতিনিয়ত। তারপরও সুযোগে ভ্রমণ করতে ভুলি না কখনোই। গেল রমজানের সপ্তাহখানেক আগে আমরা ক'জন উদীয়মান তরুণ গিয়েছিলাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কন্যাখ্যাত সিলেটের ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। সেই উপাখ্যান আজ আপনাদের সামনে গল্পে গল্পে জানান দেব। সূর্যের কিরণ লাল টুকটুকে রূপ ধারণ করতে না করতে আমরা গাড়িতে ওঠে বসে পড়ি।
ভ্রমণসঙ্গী পরিমাণ থেকে অতিরিক্ত হওয়ায় আমাদের আঁটোসাটো করে বসতে হয়। একদিকে দূরের ভ্রমণ, অপরদিকে দু'পাশের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হওয়ার মতোন অবস্থা। আমরা সিলেটের বিয়ানীবাজার আহমদাবাদ মাদরাসার শিক্ষক স্টাফ। এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন শায়খ আহমদ আলি বাঁশকান্দি রাহিমাহুমুল্লাহ'র বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা নূরুল ইসলাম আহমদাবাদী রাহিমাহুমুল্লাহ।
ভ্রমণসঙ্গীর সবাই টগবগে তরুণ। আমরা যেখান থেকে গাড়িতে উঠেছি, ঠিক সেখানের অদূরেই বাংলা-ভারত শেষ সীমান্ত তথা করিমগঞ্জ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য। আবার আমাদের ভ্রমণও বাংলারই একপ্রান্তের শেষ সীমান্ত ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। সাধরণত শিক্ষক স্টাফ ভ্রমণে যাওয়ার দৃশ্য খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আমরা নিয়ম-অনিয়মের অভিযোগের দেয়ালে না পড়ে একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে একসঙ্গে এক কাফেলা রওনা দিই।
অজপাড়াগাঁ থেকে শহরের মাটিতে পা রাখতে বেলা প্রায় বারোটার কাছাকাছি হয়ে যায়। অনন্তর শহরের একটি মানসম্মত রেস্তোরাঁ থেকে দুপুরের খাবার কিনে তারপর আবারও যাত্রা করি। জ্যামজাম পেছনে ফেলে একসময় কাফেলার চোখ আটকে যায় সিলেট বিমানবন্দরের ভেতরের দৃশ্যে। সাধারণত ভেতরের দৃশ্য দেখা যায় না, কিন্তু ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর অথবা কোম্পানিগঞ্জের যাত্রীর এটি সহজতর বিষয়। কম মূল্য চুকিয়ে দেখা সম্ভবপর। ওইদিকে বেশ কিছু জায়গায় সারি সারি গাছের মেলা দৃশ্যমান হয়েছে আমাদের। সঙ্গে পাথর ভাঙার জন্য ক্রাশারও পরিলক্ষিত হয়।
একটি কথা বলব বলব করে তো ভুলেই গেছি বেমালুম। গাড়ির ভেতরের অবস্থা আরও আনন্দময়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ডুবন্ত এক কাফেলা। সবাই হাসি-খুশিতে মেতে ওঠেছে। আমাদের শিক্ষক স্টাফের অনেকেই বিয়েশাদী করেননি অদ্যাবধি। এই নিয়ে তো হৈহুল্লোড়ের শেষ নেই। কার বিয়ে কবে হবে, কখন কার আলুর তরকারি নিজের জঠরে দেব— কত্তকিছুই না গল্পের ছলে বলা হচ্ছে।
কোথাও ভ্রমণে যাব আর কিছু বাজানো হবে না, তা তো হতেই পারে না। শুরু থেকেই হৃদয়গ্রাহী মর্মস্পর্শী তারানা বাজতেই ছিল। কখনো বিপ্লবী সংগীতের সুরে আমরাও গুনগুন করছি মন্থর গতিতে। কথার ফাঁকফোকরে কখনো-সখনো বিভিন্ন বিষয়ে অভিব্যক্তি বলার পসরা সাজিয়ে দিলে সানন্দে বলে যাচ্ছি নিজের হৃদয়ের মণিকোঠায় জমে থাকা স্বপ্ন বুননের ইতিকথা।
গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মাঝপথে দর্শন হয়েছে কতকিছুর। ভালোলাগার বিহ্বলতায় আমরা থিতু নিই পারাপারের ঘাটে। সেখানে পৌঁছে বুঝতে পারি, এখানেও আছে অনৈতিকতার রাজনীতির অপচর্চা। পনেরো মিনিটের রাস্তা হেঁটে যাওয়ার বদলে জনপ্রতি শখানেক টাকা দিয়ে টিকিট কেটে তারপর নৌকা বহর করে যেতে হয় দর্শনীয় স্থানে। আমরাও গেলাম সবার মতোন একটি নৌকা ভাড়া করে।
নৌকায় যখন উঠতে যাব, তখন আমাদের মাথার ওপর ছিল কাঠফাটা রোদের তীব্র জ্বলজ্বলানি। ভাবলাম ঠান্ডা জাতীয় কিছু খেয়ে নিই সবাই। যেই ভাবা সেই কাজ। একজনের পক্ষ থেকে ক্ষীরা খেয়ে প্রশান্তিময় হাসি দিয়ে নৌকায় পা রাখি। নৌকায় উঠতেই খেলা শুরু অন্যটি। কেউ বোতলের পানি দিয়ে অন্যের ওপর ছিটাতে শুরু করে। কেউ আবার আঁকাবাঁকা নদীর পানি দিয়ে ফুর্তিবাজিতে মেতে । এভাবে হৈ-হস্তুল দিয়ে আমরা গন্তব্যে নেমে পড়ি।
সেখানে পৌঁছে দেখতে পাই ভ্রমণপিয়াসী লোকের সমাগম। সারি সারি খোলা ছাতা দিয়ে সাজানো সমাগমস্থল। নিচে চৌকির মতোন, আকারে লম্বা সাজানো হয়েছে বসার স্থান। বসে আছেন দূর-দূরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থী। সঙ্গে চলছে ফটো তোলার হিড়িক। জনমানবহীন এই শূন্য জায়গা, কিন্তু দর্শনের জন্য আগমন ঘটে অগণিত মানুষের। ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ছে আপন গতিতে শীতল স্বচ্ছ পানি। সেই পানিতে উঁকি দিলে দেখা যায় নিজের প্রতিচ্ছবি। আহা! কী নিদারুণ দৃশ্য। কর্ণকুহরে বাজে পানি গড়ানোর মৃদু শব্দ। আমরা মন্থর গতিতে চলে যাই সীমান্তের ওপার-এপার তথা দুই দেশের একেবারে দ্বারপ্রান্তের ছোট্ট একটি মসজিদে।
মসজিদের টেপের পানি তপ্ত গরম ছিল, তবুও তাতেই ওজুর কাজ সেরে মসজিদে ঢুকে পড়ি। দু'জন ছাড়া বাকিরা জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। যোহরের নামাজ আদায়ান্তে চলে যাই ফুটবল খেলার মাঠে। শৈশবের সেই খেলাধুলার পর আর সেরকম হয়ে উঠেনি খেলাধুলা। তবুও সখের বশতে কাফেলা দু'ভাগ হয়ে নেমে পড়ি দৌড়ঝাঁপে। একসময় সবাই হাঁপিয়ে ওঠে, কিন্তু মজার কথা হচ্ছে; আমাদের টিম বিরতির আগেই প্রতিপক্ষের পাল্টা জবাব দিয়ে আরও দুটি গোল দেয়। খেলার শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় পক্ষের পাল্টা জবাব দেওয়ার সম্ভব হয়নি। ওপরে ছাতিফাটা রোদ, নিচে দৌড়ের ছুটে অবস্থা অবর্ণনীয়, শরীর থেকে ঝরছে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা।
গেঞ্জি-পায়জামা ভিজে একেবারে জবুথবু; কিন্তু তবুও তাতে ছিল আনন্দ। খেলা পরবর্তীকালে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি, তখন শহর থেকে আনা খাবারের প্যাকেট সামনে উপস্থিত করা হলে মুহূর্তের মধ্যে লুফিয়ে নিই নিজের খাবার, কারণ পেটের খিদে তখন অনুভূত হয় চরম পর্যায়ের। খানাপিনার পর আমরা সাদাপাথরের নালায় নেমে পড়ি এবং শৈশবের মতোন পানির মধ্যে বিভিন্ন খেলায় ডুবিয়ে যাই। ভোলাগঞ্জ সাদাপাথরের শীতল পানি দিয়ে উত্তপ্ত শরীরকে শান্ত করে এই পর্বের পরিসমাপ্তি করি। তারপর কাপড়চোপড় পরে সারাদিনের ক্লান্ত দেহকে টেনেহিচড়ে কোনোমতে নৌকার গলুইয়ে পা রাখতে সক্ষম হই। অনন্তর ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে যাত্রা করি আপন গন্তব্যে...
লেখক: আবদুল কাদির ফারূক, শিক্ষক ও কলামিস্ট
বাংলাবার্তা/এমআর