
ছবি: সংগৃহীত
চাঁদের আলোয় ভাসা নিঃশব্দ সমুদ্রপৃষ্ঠে হঠাৎ করে চোখে পড়ে একটি কালো ছায়া। দূর থেকে মনে হয় যেন এক বিশাল যুদ্ধজাহাজ দাঁড়িয়ে আছে মহাসমুদ্রের বুকে। কোনো শব্দ নেই, নেই মানুষের কোলাহল। শুধুই বাতাসে উড়ে বেড়ায় ধ্বংস, স্মৃতি আর নিঃশ্বাসের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি। দ্বীপটির নাম হাশিমা—জাপানিদের মুখে আদরের নাম ‘গুঙ্কানজিমা’, যার অর্থ যুদ্ধজাহাজ দ্বীপ। কিন্তু এই নামের পেছনের ইতিহাস কোনো মহিমার নয়, বরং এটি সাক্ষ্য দেয় আধুনিকতার চূড়ান্ত উত্থান আর নির্মম পতনের এক করুণ অধ্যায়ের।
জাপানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নাগাসাকি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাশিমা দ্বীপ এককালে ছিল আধুনিক নগর জীবনের মডেল। মাত্র ৬.৩ হেক্টর আয়তনের এই দ্বীপে ছিল বিশাল কংক্রিটের ভবন, সিনেমা হল, স্কুল, হাসপাতাল, বাজার এবং হাজার হাজার মানুষের বসবাস। এটি এমন একটি স্থান যেখানে প্রকৃতি ও প্রযুক্তির দ্বন্দ্ব আর সহাবস্থান একত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে এক ধূসর পাথরের ক্যানভাসে।
শিল্পায়নের সূচনা ও স্বর্ণযুগ
সবকিছু শুরু হয় ১৮৮৭ সালে, যখন সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে থাকা কয়লার খনি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। ১৮৯০ সালে মিতসুবিশি কর্পোরেশন এই দ্বীপটি কিনে নেয় এবং সেখানে চালু করে একটি পূর্ণাঙ্গ কয়লা খনি। দ্রুত গড়ে উঠতে থাকে অবকাঠামো, শ্রমিকদের জন্য নির্মিত হয় আবাসন, গড়ে ওঠে পরিবার, বসতি, স্কুল, বিনোদনের স্থান। ১৯৫৯ সালে এই ক্ষুদ্র দ্বীপে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৫,২৫৯ জনে—এটি ছিল সেসময় বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।
ভবনগুলো ছিল জাপানে নির্মিত প্রথম কংক্রিটের তৈরি বহুতল ভবনের মধ্যে অন্যতম। অল্প জায়গার মধ্যে গড়ে ওঠা ঘিঞ্জি অথচ সুসংগঠিত এই জীবন ছিল শিল্পায়নের বিজয়গাথা। শিশুদের হাসি, পাঠশালার ঘণ্টাধ্বনি, রান্নাঘরের ধোঁয়া আর সিনেমা হলের গান এই দ্বীপকে করত জীবন্ত এক শহর।
শোষণের অন্ধকার ছায়া
তবে এই উজ্জ্বলতা একপাশে রেখে গেলে যে চিত্রটি উঠে আসে, তা অনেকটা গা ছমছমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সামরিক জোটবদ্ধতার অংশ হিসেবে কোরিয়া ও চীনের হাজার হাজার শ্রমিককে জোরপূর্বক আনা হয় এই দ্বীপে। তারা ছিল মূলত শিশু-কিশোর ও তরুণ, যাদের বয়স ছিল মাত্র ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। অমানবিক পরিবেশে, অনবরত খনির গভীরে কাজ করতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারান। শ্রম ও মৃত্যুর এই ইতিহাস আজও দেওয়ালের ফাঁকফোকরে, মরচে ধরা লোহার সিঁড়িতে, ভাঙা দরজার কড়ায় বেঁচে আছে।
জাপান সরকার পরে এই জোরপূর্বক শ্রম ব্যবস্থার বিষয়টি স্বীকার করে। যদিও ইউনেস্কো ২০১৫ সালে দ্বীপটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে, এই স্বীকৃতির প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে।
হঠাৎ পতন ও নীরবতা
১৯৭৪ সালে দ্বীপটির কয়লার মজুত ফুরিয়ে গেলে মাত্র একদিনের নোটিশে সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়। কর্মসংস্থান হারিয়ে দ্বীপটি এক মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যায়। তালা পড়ে ঘরের দরজায়, শিশুদের খেলনা পড়ে থাকে ধূলি জমা মেঝেতে, রান্নাঘরের পাত্র ধীরে ধীরে মরচে ধরে—এ যেন একটি জীবন্ত শহরের অকালমৃত্যু।
দীর্ঘ দিন ধরে পরিত্যক্ত থাকা এই দ্বীপে মানুষ ফিরে আসে পর্যটকের রূপে। ২০০৯ সালে দ্বীপের কিছু অংশ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়, যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে অধিকাংশ এলাকাই এখনো সাধারণের জন্য বন্ধ। যাঁরা আসেন, তাঁরা ইতিহাসের নিঃশ্বাস নিতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন, কেউবা আবার চোখ বুজে কল্পনা করেন সেই দিনগুলো—যখন এই দ্বীপ ছিল জীবনের প্রতিচ্ছবি।
একটি নিঃশব্দ দলিল
হাশিমা এখন কেবল একটি ভগ্ন শহর নয়, এটি এক জীবন্ত প্রতীক। যেখানে উন্নয়নের উন্মাদনা, মানুষের শ্রম, শোষণের চিত্র ও প্রাকৃতিক নিয়ম একসাথে মিশে গেছে। এটি মনে করিয়ে দেয়, আধুনিকতা কত দ্রুত ধ্বংসে রূপ নিতে পারে, যদি সেই আধুনিকতার ভিত্তি হয় শোষণ ও অবিবেচনা।
আজ হাশিমা দ্বীপ দাঁড়িয়ে আছে এক ভুতুড়ে নিঃসঙ্গতা নিয়ে, অথচ তার শরীরে লেগে আছে হাজারো মানুষের ঘাম, কান্না, স্বপ্ন ও চিৎকারের চিহ্ন। এটি এক শহরের ইতিহাস, যেখানে সময় থেমে গেছে—কিন্তু তার গল্প চলতে থাকে।
হাশিমা আমাদের শেখায়, আধুনিকতা মানে কেবল অট্টালিকা নয়—মানবিকতা না থাকলে তা এক সময় পরিণত হয় নিঃসঙ্গ ভুতুড়ে দ্বীপে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ