
ছবি: সংগৃহীত
ইস্টার সোমবার, রোমের এক শান্ত সকাল। ভ্যাটিকান সিটির কাসা সান্তা মার্তায় নিজের আবাসস্থলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আধুনিক সময়ের অন্যতম প্রভাবশালী ধর্মগুরু, পোপ ফ্রান্সিস। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। দীর্ঘ বারো বছর ধরে তিনি ছিলেন রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ নেতা এবং বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৩০ কোটির বেশি বিশ্বাসীর আধ্যাত্মিক অভিভাবক।
পোপের মৃত্যুতে বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। সেই সঙ্গে ভ্যাটিকান রাজ্যে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক এবং অত্যন্ত গোপনীয় প্রক্রিয়া— নতুন পোপ নির্বাচনের আয়োজন, যার আনুষ্ঠানিক নাম "কনক্লেভ"। সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে, ভ্যাটিকানের অন্দরমহলের নিষ্ঠাবান অনুশাসনে চলে এই প্রক্রিয়া—যা রোমান ক্যাথলিক চার্চের সহস্রাব্দ পুরনো ঐতিহ্য, ধর্মতত্ত্ব ও ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রতীক।
পোপ ফ্রান্সিস: একজন প্রগতিশীল ধর্মপিতার প্রস্থান
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন ইতিহাসে প্রথম জেসুইট পোপ এবং প্রথম লাতিন আমেরিকান যিনি ক্যাথলিক চার্চের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন। মানবিকতা, দরিদ্রদের অধিকার, পরিবেশ রক্ষা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক চার্চ গঠনের বিষয়ে তার অবস্থান তাকে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় করে তোলে। তার মৃত্যুর পর ক্যামেরলেনগো কার্ডিনাল কেভিন ফেরেল এক বিবৃতিতে বলেন, “আজ সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে রোমের বিশপ ফ্রান্সিস স্বর্গীয় পিতার সান্নিধ্যে ফিরে গেছেন। তাঁর জীবন ছিল প্রভু ও চার্চের সেবায় উৎসর্গিত।”
কীভাবে শুরু হয় পোপ নির্বাচনের কনক্লেভ?
পোপের মৃত্যুর পর, ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শুরু করেন ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ ধর্মযাজকগণ—কলেজ অব কার্ডিনালস। এদের মধ্যে যাদের বয়স ৮০ বছরের নিচে, তারা ভোটার হিসেবে যোগ দেন এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায়। বর্তমানে এমন ভোটার কার্ডিনালের সংখ্যা প্রায় ১২০ জন, যাদের দুই-তৃতীয়াংশই পোপ ফ্রান্সিস নিজেই মনোনীত করেছিলেন—যার ফলে তার উদার ধর্মতত্ত্ব নতুন পোপ নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
এই ভোটাভুটি চলে এক অতি গোপন বৈঠকে, যার নাম "কনক্লেভ"—লাতিন শব্দ cum clave অর্থাৎ "চাবিসহ বন্ধ করা", যা বোঝায়—ভোট চলাকালে নির্বাচকরা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকেন, বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ।
নির্বাচনী পর্ব: গোপনতা, প্রথা ও আধ্যাত্মিক আবহ
কার্ডিনালদের অবস্থান হয় কাসা সান্তা মার্তায়—সেই ভবন যেখানে পোপ ফ্রান্সিস নিজেও বাস করতেন। এখান থেকে তারা প্রতিদিন দু’বার করে যান ভ্যাটিকানের সবচেয়ে পবিত্র স্থান সিস্টিন চ্যাপেল-এ, যেখানে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর মহাকাব্যিক শিল্পকর্ম তাদের ওপর ছায়া ফেলে রাখে—একটি অতীন্দ্রিয় পরিবেশ তৈরি করে।
প্রথম দিন শুরু হয় প্রার্থনা সভা বা ‘মেস’-এর মাধ্যমে। এরপর প্রতিটি কার্ডিনাল একটি ব্যালটে লেখেন: "Eligo in summum pontificem"—অর্থাৎ “আমি সর্বোচ্চ ধর্মগুরু হিসেবে নির্বাচন করছি” এবং তার নিচে নির্বাচিত ব্যক্তির নাম। প্রতিদিন চারবার ব্যালটিং হয়—সকাল ও বিকালে দুবার করে।
একটি বিশেষ চুল্লিতে ব্যালটগুলো পোড়ানো হয়। ধোঁয়ার রঙই জানান দেয় বিশ্ববাসীকে—কালো ধোঁয়া মানে সিদ্ধান্ত হয়নি, সাদা ধোঁয়া মানে নতুন পোপ নির্বাচন সম্পন্ন। এই ঐতিহ্যগত পদ্ধতিকে ঘিরেই অপেক্ষা করতে থাকে সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষ ও বিশ্বমিডিয়া।
পর্দার আড়ালের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা
কনক্লেভ শুরুর আগে সিস্টিন চ্যাপেলের দরজাগুলো বন্ধ করে ঘোষণা দেওয়া হয় “Extra omnes”—‘সবাই বেরিয়ে যান’। কেবলমাত্র ভোটার কার্ডিনাল, কিছু নির্ধারিত চিকিৎসক এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তা ভেতরে থাকেন। তাদের জন্য টোটাল ব্ল্যাকআউট করা হয়—কোনো মোবাইল, ইন্টারনেট, রেডিও, সংবাদপত্র এমনকি চিঠিপত্রও অনুমোদিত নয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চ্যাপেলে ইলেকট্রনিক বাগ বা লুকানো ক্যামেরা খুঁজে বের করতে স্ক্যানিং চালায়। এই পর্যায়ে পোপ নির্বাচন প্রকৃত অর্থেই এক বৈশ্বিক কিন্তু নিভৃত আয়োজন হয়ে ওঠে।
সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা: “Habemus Papam”
যদি প্রথম ৩০টি ব্যালটে কারও দুই-তৃতীয়াংশ ভোট না আসে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নতুন পোপ বেছে নেওয়া হয়। নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রথমে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি পদের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন কিনা। সম্মতি দিলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় Room of Tears-এ—একটি ব্যক্তিগত ঘর যেখানে তিনি সাদা পোপীয় পোশাক ও লাল স্লিপার পরিধান করেন।
সেখানে অপেক্ষায় থাকে বিভিন্ন মাপের সাদা পোশাক, যাতে তা তাৎক্ষণিকভাবে মানানসই হয়। এরপর সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ব্যালকনিতে এসে কার্ডিনালদের ডিন ঘোষণা দেন সেই ঐতিহাসিক বাক্য:
“Annuntio vobis gaudium magnum: Habemus papam”
(“আমি তোমাদের একটি মহাসমাচার জানাচ্ছি: আমাদের একজন পোপ আছেন!”)
অতীতের দীর্ঘ কনক্লেভ ও সম্ভাব্য ভবিষ্যত
ভ্যাটিকানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ কনক্লেভ হয়েছিল ১৯২২ সালে—পাঁচ দিন লেগেছিল পোপ নির্বাচনে। তবে আধুনিক যোগাযোগ ও তুলনামূলক স্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়ার কারণে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, যেহেতু বর্তমান ভোটারদের বড় একটি অংশ পোপ ফ্রান্সিসের সময় মনোনীত, তাই নতুন পোপও তার উদারতা, অন্তর্ভুক্তি, দরিদ্রবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশবিষয়ক মতাদর্শ বহন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পোপ নির্বাচন মানে শুধু একজন ধর্মগুরুকে মনোনয়ন দেওয়া নয়—এটি হলো এক পবিত্র উত্তরাধিকার স্থাপন, যার প্রভাব পড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনে। ভ্যাটিকানের কনক্লেভ হলো তারই এক আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক ও কূটনৈতিক প্রতিফলন।
পর্দার আড়ালে চলে এই বিশাল আয়োজন, কিন্তু তার ঘোষণা হয় বিশাল এক ব্যালকনি থেকে, যেখানে সমবেত জনতার মুখে ধ্বনিত হয় কেবল একটি শব্দ—“আমেন”।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, ভ্যাটিকান নিউজ
বাংলাবার্তা/এমএইচ