
ছবি: সংগৃহীত
সিসিলির উত্তরে, সমুদ্রতীরবর্তী সবুজ পাহাড়ে ঘেরা মেসিনা প্রদেশে অবস্থিত ছোট্ট, নির্জন গ্রাম ‘কানেটো ডি কারোনিয়া’। একসময় যেটি ছিল নিঃসন্দেহে এক মনোরম ও প্রশান্ত গ্রামীণ জনপদ—আজ তা ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে এক অনাবিষ্কৃত, অদ্ভুত এবং ভয়াবহ রহস্যের জন্য। ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এক বিস্ময়কর আগুনের ঘটনাপ্রবাহ এই গ্রামকে রূপ দিয়েছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, রহস্য ও কল্পনাপ্রবণ গল্পের এক জীবন্ত জাদুঘরে। সময়ের পরিক্রমায় আজও এ ঘটনার নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি, ফলে কানেটো ডি কারোনিয়ার নাম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ‘দহনগ্রস্ত রহস্যময় গ্রাম’ হিসেবে।
আগুন, অথচ না-থাকা আগুনের উৎস!
২০০৪ সালের জানুয়ারির এক মধ্যরাতে কানেটোর স্থানীয়রা প্রথম অনুভব করেন কিছু অস্বাভাবিক—কেউ দেখলেন ঘরে রাখা বিছানার তোশক হঠাৎ দাউ দাউ করে জ্বলছে, আবার কেউ লক্ষ্য করলেন রেফ্রিজারেটরের পেছনের তারবিহীন অংশ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। পরদিন সকাল হতে না হতেই গোটা গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রামের একাধিক ঘরে শুরু হয় একই ধরনের অদ্ভুত অগ্নিকাণ্ড—টেলিভিশন, রাইস কুকার, সোফা, ফ্রিজ, গদি, এমনকি জলপাই গাছের নিচে পড়ে থাকা শুকনো পাতা পর্যন্ত জ্বলে উঠতে থাকে!
বিস্ময়ের বিষয় হলো, এসব আগুনের কোনো নির্দিষ্ট উৎস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ফায়ার সার্ভিস এসে দেখল, যে ঘরে আগুন লেগেছে, সেখানে বৈদ্যুতিক সংযোগই নেই! বিদ্যুৎ কোম্পানি সর্তকতাবশত পুরো গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, কিন্তু তাতেও আগুন থামেনি। ফলে সাধারণ মানুষ দ্রুত গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়, গ্রাম পরিণত হয় এক প্রকার ভূতের নগরে।
বিজ্ঞান ও সামরিক বাহিনীর রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা
ঘটনাটি প্রথমে স্থানীয় প্রশাসনের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়ায়। পরে বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় উঠে আসে এবং ইতালির সেনাবাহিনী, বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক গবেষক, ভূতত্ত্ববিদ ও এমনকি ইউএফও গবেষকরাও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। মোট ৪০টিরও বেশি অনির্বচনীয় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল বলে সরকারি নথিতে উল্লেখ রয়েছে।
প্রথমদিকে মনে করা হয় হয়তো ভূগর্ভস্থ গ্যাস লিক বা কোনো প্রাকৃতিক গ্যাসীয় বিক্রিয়া থেকে এসব অগ্নিকাণ্ড ঘটছে, তবে তা পরীক্ষায় খারিজ হয়ে যায়। এরপর নজর পড়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গের দিকে। একাধিক গবেষক, বিশেষ করে ইতালির সামরিক গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা সন্দেহ করেন, অদৃশ্য ইলেকট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ বা বিকিরণের কারণে ধাতব যন্ত্রপাতি ও বৈদ্যুতিক বস্তুতে তাপ সৃষ্টি হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আগুন লাগছে।
২০০৭ সালে এক সরকারি রিপোর্টে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, ‘একধরনের অজানা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস (EMP)-এর কারণে এই আগুন লাগতে পারে, যেটি হয়তো কোনো গোপন সামরিক পরীক্ষা বা শত্রু রাষ্ট্রের গুপ্ত প্রযুক্তির প্রভাব।’ কিন্তু পরবর্তী অনুসন্ধানে এমন কোনো পরীক্ষা বা কার্যক্রমের প্রমাণ মেলেনি।
ভিনগ্রহের প্রাণী নাকি অতিপ্রাকৃত শক্তি?
যেখানে বিজ্ঞান ব্যর্থ, সেখানে স্থান নেয় কল্পনা ও বিশ্বাস। গ্রামের কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেন, এটি কোনো পুরোনো অভিশাপ বা অতৃপ্ত আত্মার কাজ। অনেকে বলেছিলেন, তারা গভীর রাতে এক ধরনের গম্ভীর গর্জন বা শব্দ শুনতেন, যার কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যেত না। কিছু ধাতব বস্তু হঠাৎ গরম হয়ে যেত, আবার অজানা কোনো অশরীরী শক্তির উপস্থিতিও কেউ কেউ অনুভব করতেন।
একপর্যায়ে ইউএফও বিষয়ক গবেষকরাও আগ্রহ দেখান এই ঘটনায়। কানেটো ডি কারোনিয়ার আকাশে একাধিকবার অজানা উড়ন্ত বস্তু (UFO) দেখা গেছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেন। তাদের মতে, এসব আগুন আসলে ভিনগ্রহের প্রাণীদের প্রযুক্তিগত বিকিরণের প্রতিক্রিয়া।
ভয় না কাটলেও গ্রামে ধীরে ধীরে ফেরত মানুষ
২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যবর্তী সময়টায় গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ পুরোপুরি অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন। অনেক বাড়ি খালি হয়ে পড়ে, জমি অনাবাদি থেকে যায়। তবে সময়ের ব্যবধানে এই আগুনের প্রকোপ কমতে শুরু করে, যদিও মাঝে মাঝে আবার sporadic অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সতর্কতা হিসেবে কিছু ঘর পুনঃনির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তা বাহিনী দীর্ঘদিন নজরদারি করে।
তবে আজও এই রহস্যের সুনির্দিষ্ট সমাধান মেলেনি। এখনো গবেষকরা সময়-সময় এলাকায় এসে তথ্য সংগ্রহ করেন, তবে গ্রামের মানুষের মধ্যে সেই পুরোনো ভয় এখনো একেবারে কাটেনি।
ইতিহাসে এক রহস্যময় অধ্যায়
কানেটো ডি কারোনিয়ার সেই একের পর এক আগুন লাগার রহস্য আজও অমীমাংসিত। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সামরিক গোয়েন্দা, ভূতত্ত্ব, এমনকি ধর্মীয় ব্যাখ্যার সমন্বয়েও এই রহস্যের পর্দা পুরোপুরি ফাঁস হয়নি। এটি আজও বিশ্বজুড়ে এক গবেষণা-আকর্ষণ, মিডিয়া আলোচনা এবং কল্পনাপ্রবণ লেখার অন্যতম অনুপ্রেরণা।
একটি ছোট গ্রাম, যার জনসংখ্যা একসময় ছিল মাত্র কয়েকশ’, সে গ্রাম আজও ইতিহাসে লেখা রয়েছে—এক রহস্যময় ‘জ্বলন্ত গ্রাম’ হিসেবে।
সূত্র: এনবিসি নিউজ, ইতালিয়ান রিসার্চ কাউন্সিল, নিউইয়র্ক টাইমস আর্কাইভ, রয়টার্স
বাংলাবার্তা/এমএইচ