সংগৃহীত ছবি
ঢাকা: সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে যে তথ্য পাচ্ছে অধিদপ্তর, তা খণ্ডিত। ফলে ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।
এমনকি প্রতিদিন কত মানুষ ডেঙ্গু পরীক্ষা করছে এবং তাদের মধ্যে কত শতাংশের ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে, সে তথ্যও নেই অধিদপ্তরের কাছে। তবে এই খণ্ডিত তথ্যের ভিত্তিতেই ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলছে অধিদপ্তর।
গতকাল সোমবার দেশের চলমান ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ডেঙ্গুর নমুনা পরীক্ষার সব তথ্য তাদের কাছে নেই। করোনার সময় ডিজিটাল পদ্ধতিতে তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই ডেটা এন্ট্রি অপারেটর দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে করোনার প্রায় শতভাগ তথ্য তারা সরবরাহ করতে পারতেন। এই পুরো প্রক্রিয়ার জন্য অনেক জনবল প্রয়োজন। কিন্তু ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা হয়নি। সেটি হলে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাবে। বর্তমানে ঢাকার ২০টি সরকারি ও ৪২টি বেসরকারি হাসপাতাল এবং ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকে ডেঙ্গুর তথ্য পাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই কর্মকর্তা বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল না। করোনার সময় তারা প্রথম তথ্য দিতে শুরু করে। ঢাকার আরও ৩০টি বেসরকারি হাসপাতাল আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য দেবে।
খণ্ডিত তথ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গুর আরও কিছু বেসরকারি তথ্য অধিদপ্তরের কাছে আসে। কিন্তু সেগুলো অসম্পূর্ণ। এসব অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে কোনো কাজ হয় না।
গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে বছরের সর্বোচ্চ আটজনের মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ সাতজনের মৃত্যুর রেকর্ড ছিল গত ১৫ জুলাই। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেল ১১৪ জন। এ সময় নতুন করে ১ হাজার ৫৮৯ জন রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আরেক দিন গত রবিবার এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২৪ জন।
পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে : গতকালের সংবাদ সম্মেলনে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাশেদা সুলতানা। তিনি বলেন, প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার ও ইনফরমেশন ডেস্ক আছে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় যারা কাজ করবেন, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালেই পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত আছে।
এই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা সিটির বাইরে দেশের প্রতিটি উপজেলা হাসপাতাল থেকে শুরু করে মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত ডেঙ্গুর পৃথক কর্নার এবং শয্যা প্রস্তুত আছে। ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার আরও বাড়লেও চিকিৎসাসেবায় কোনো ঘাটতি হবে না।
শনির আখড়া থেকে বাড্ডা ডেঙ্গুর ক্লাস্টার জোন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম গতকাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন, এ বছর ডেঙ্গু বাড়বে ও ডেঙ্গুর ক্লাস্টার জোনগুলোর (গুচ্ছ সংক্রমণ এলাকা) ব্যাপারে অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা অনেক আগে থেকেই প্রতিদিন সিটি করপোরেশনকে জানিয়ে আসছে। যেসব জায়গায় মশা বেশি সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন শনির আখড়া থেকে বাড্ডা পর্যন্ত ডেঙ্গুর লম্বা বেল্ট। এই পুরো এলাকায় মশা বেশি, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। এই তথ্য প্রতিদিনই দেওয়া হচ্ছে। এসব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অনেক আগেই শেয়ার করা হয়েছে। এখন নিয়ন্ত্রণে বাকি কাজটা তারা করবে।
অন্য রোগের রোগীদের ডেঙ্গু হলেই হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ : অন্য যেকোনো রোগে আক্রান্তদের ডেঙ্গু পজিটিভ হলেই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। গতকাল ঢাকার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, যাদের কোমর্বিডিটিজ (অন্যান্য রোগ) আছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন, ক্যানসারে আক্রান্ত বা ক্যানসারের জন্য ওষুধ খান; ডেঙ্গু ধরা পড়লে তাদের অবশ্যই অবশ্যই হাসপাতালে আসতে হবে। এটা না হলে পরে সামাল দেওয়া যাবে না। বাড়িতে বসে ওই ধরনের রোগীদের চিকিৎসা সম্ভব নয়।
বদলে গেছে ডেঙ্গুর লক্ষণ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডেঙ্গুজ্বরের আগে যে লক্ষণ ছিল তা সম্প্রতি বদলে গেছে। আগে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো ছিল শুরুতেই জ্বর আসত; শরীরে ব্যথা; মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা; চামড়ায় লালচে দাগ, এখন প্রায় সময় জ্বর আসছে না, প্রাথমিক পর্যায়েই ডায়রিয়া ও শ্বাসকষ্ট, পেটব্যথা, বমি, পেটে-বুকে পানি আসা, শরীরে খিঁচুনি এসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। অধিদপ্তর জানিয়েছে, জরুরি প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবা পেতে ১৬২৬৩ হটলাইন সেবা চালু রয়েছে।
বেশি মৃত্যু নারীদের : ডেঙ্গুতে এ বছর নারীরা বেশি মারা গেছেন। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত যে ১১৪ জন ডেঙ্গুতে মারা গেছেন, তাদের মধ্যে ৬৬ জনই নারী, যা মৃত্যুর ৫৮ শতাংশ। মৃতদের বাকি ৪৮ জন পুরুষ। অন্যদিকে, মৃত্যুর ২১ শতাংশই ৫-১৮ বছর বয়সী শিশু। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত মারা যাওয়া ১১৪ জনের মধ্যে ২৪ জনই শিশু। তাদের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের শিশুর সংখ্যা পাঁচজন, ৫-১০ বছরের শিশু সাতজন ও ১০-১৮ বছরের শিশু ১২ জন।
এরপর ৪০-৬০ বছর বয়সী ২৭ জন, ৬০-৮০ বছর বয়সী ১৪, ১০-১৮ বছর বয়সী ১২, ৫-১০ বছর বয়সী ৭, ৫ বছরের নিচে ৫ ও ৮০ বছরের ঊর্ধ্বে ২ জন মারা গেছেন।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এ বছর আক্রান্তদের বেশির ভাগই ১৮-৪০ বছরের মধ্যে। এখন পর্যন্ত যে ২২ হাজার ৪৬৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তাদের মধ্যে এই বয়সী রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ ৪ হাজার ১২০ জন।
ঢাকায় ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি নারী রোগীর সংখ্যা ৫ হাজার ৯১০ জন ও পুরুষ ৮ হাজার ৭৮৭ জন এবং ঢাকার বাইরে নারী ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ৩৯৩ জন নারী ও ৫ হাজার ৩৭৭ জন পুরুষ।
সর্বোচ্চ মৃত্যু এ বছর : দেশে ডেঙ্গুর ২৩ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত এ বছর সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এ বছর গতকাল পর্যন্ত ভর্তি রোগীর শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ মারা গেছে। এরপর ২০২০ সালে ভর্তি রোগীর শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ, ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৫, ২০২১ সালে শূন্য দশমিক ৩৭, ২০১৮ সালে শূন্য দশমিক ২৬ ও ২০১৯ সালে শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ রোগী মারা যায়।