
ছবি: সংগৃহীত
মানব হৃদপিণ্ড যদি একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আর আগের মতো হয় না—এটিই চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতদিনের ধারণা। কিন্তু সম্প্রতি এক যুগান্তকারী গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড ব্যবহার করা কিছু রোগীর আসল হৃদপিণ্ডের পেশিকোষ আবার পুনরুৎপাদন শুরু করেছে। এ আবিষ্কার ভবিষ্যতে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন বা আজীবন কৃত্রিম ডিভাইস ব্যবহারের বিকল্প পথ উন্মুক্ত করতে পারে।
এই গবেষণাটি যৌথভাবে সম্পন্ন করেছেন ইউনিভার্সিটি অব এরিজোনা কলেজ অব মেডিসিন ও সার্ভের হার্ট সেন্টারের বিজ্ঞানীরা। গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী Circulation-এ।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (CDC) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতি বছর ৭০ লাখের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হার্ট ফেইলিউরে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে অন্তত ১৪ শতাংশের মৃত্যু ঘটে। বর্তমানে হৃদপিণ্ডের এই ব্যর্থতা রোধে সম্পূর্ণ কার্যকর কোনো চিকিৎসা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীদের শরীরে লাগাতে হয় একটি যান্ত্রিক হৃদপিণ্ড, যাকে বলা হয় লেফট ভেন্ট্রিকুলার অ্যাসিস্ট ডিভাইস (LVAD)।
হার্ট সেন্টারের পরিচালক ড. হেশাম সাদেক বলেন, “দেহের অন্যান্য পেশি যেমন বিশ্রামে থাকলে নিজে নিজে পুনরায় গঠিত হয়, হৃদপিণ্ডের ক্ষেত্রে তা হয় না। কারণ হৃদপেশি একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা স্বাভাবিকভাবে আর ফিরে আসে না। এ জন্য কোনো চিকিৎসা পদ্ধতিও নেই।”
এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতেই ড. সাদেকের দল দীর্ঘদিন ধরে হৃদপিণ্ডের কোষের পুনর্জন্মের ওপর গবেষণা চালিয়ে আসছে। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম হৃদপিণ্ড ব্যবহারের সময় রক্ত প্রবাহ যন্ত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হওয়ায় মূল হৃদপিণ্ড একটি “বিশ্রামের অবস্থায়” থাকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পেশিগুলো নিজে নিজেই নতুন কোষ তৈরি করতে পারে।
গবেষণায় অংশ নেওয়া রোগীদের মধ্যে এক চতুর্থাংশের (২৫%) হৃৎপিণ্ডে এই পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়া কার্যকর হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, কেন বাকিদের ক্ষেত্রে তা হয়নি, তা এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি। তবে এ বিষয়টি অনুসন্ধানের মাধ্যমে আরও কার্যকর পদ্ধতি বের করার আশা করছেন তারা।
ফলাফলের গুরুত্ব
গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম হৃদপিণ্ড ব্যবহারকারীদের পেশিকোষ পুনরুৎপাদনের হার ছিল সুস্থ ব্যক্তিদের চেয়ে ছয় গুণ বেশি। ড. সাদেক বলেন, “এই তথ্যটা অভূতপূর্ব। এর মানে হলো, দীর্ঘদিন আমরা যা অসম্ভব মনে করে এসেছি—হৃদপিণ্ডের নিজস্ব পুনরুৎপাদন ক্ষমতা—তা আসলে সম্ভব। এটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত।”
২০১৪ সালের আরেক গবেষণাতেও এ বিষয়ে প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। তবে এবারের গবেষণাটি অধিকতর বিস্তৃত এবং কনক্রিট ফলাফল দিয়েছে বলে জানান গবেষকেরা।
ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
গবেষক দল এখন চেষ্টা করছে, এই কোষ পুনরুৎপাদনের কারণ ও প্রক্রিয়া আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে, যাতে তা সব রোগীর জন্য কার্যকর করা যায়। তাদের মতে, একসময় এমন দিন আসতে পারে, যখন কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড কেবল “সাপোর্ট ডিভাইস” হিসেবে নয়, বরং একটি “থেরাপিউটিক টুল” হিসেবে ব্যবহৃত হবে—যা মূল হৃদপিণ্ডের পেশিকে পুনরায় গঠনের সুযোগ করে দেবে।
এ ক্ষেত্রে গবেষণায় অর্থায়ন করেছে লিডাক্ট ফাউন্ডেশন ও ট্রান্সআটলান্টিক নেটওয়ার্ক অফ এক্সিলেন্স। গবেষকেরা মনে করেন, এ ধরনের উদ্যোগ ভবিষ্যতের হার্ট ফেইলিউর চিকিৎসার পথ তৈরি করতে এক বড় পদক্ষেপ।
ড. সাদেক বলেন, “আমরা হয়তো একদিন এমন চিকিৎসা দিতে পারব, যেখানে কৃত্রিম হৃদপিণ্ড স্থায়ী সমাধান নয়, বরং হৃদপিণ্ডকে সুস্থ করে তুলতে একটি সাময়িক সেতুবন্ধ হবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ