
ছবি: সংগৃহীত
প্রচণ্ড গরম, রোদ আর আর্দ্রতা—এই তিনে মিলে গ্রীষ্মকাল অনেকের শরীর ও মনের জন্য বয়ে আনে নানা ধরণের শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ এই সময়টিতে বাড়ে পানিশূন্যতা, হিট স্ট্রোক, ত্বকের নানা সমস্যা এবং খাদ্যজনিত রোগের আশঙ্কা। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরা এই সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
গরমের সময় শরীর স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে ঠান্ডা রাখতে ঘাম সৃষ্টি করে। তবে অতিরিক্ত ঘামের কারণে শরীর দ্রুত ডিহাইড্রেটেড বা পানিশূন্য হয়ে পড়ে, যার ফলাফল হতে পারে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা এমনকি জ্ঞান হারানোও। সেইসঙ্গে তীব্র রোদ ও উচ্চ তাপমাত্রায় দীর্ঘক্ষণ থাকা, অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া কিংবা অনিরাপদ খাবার গ্রহণ—এসব মিলিয়ে তৈরি হতে পারে হিট স্ট্রোক, ফুড পয়জনিং, অ্যালার্জি ও অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা।
এইসব রোগ ও শারীরিক সমস্যার বিস্তৃত চিত্র এবং সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নিয়েই এই প্রতিবেদনে বিশদ আলোচনা করা হলো।
১. ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা
গ্রীষ্মকালে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পানিশূন্যতা। শরীর অতিরিক্ত ঘাম ঝরিয়ে তার স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু এই ঘামের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পানি এবং লবণ বের হয়ে যাওয়ায় শরীর দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়ে।
লক্ষণ:
-
মাথা ঘোরা
-
শুষ্ক মুখ ও ত্বক
-
প্রস্রাব কম হওয়া
-
অতিরিক্ত ক্লান্তি
-
চোখ বসে যাওয়া
করণীয়:
-
পানি পিপাসা না পেলেও সারা দিন পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
-
প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
-
তরমুজ, শসা, ডাব, আনারস, কমলার মতো হাইড্রেটিং ফল বেশি খান।
-
ঘরোয়া ডাব বা স্যালাইন জাতীয় পানীয় রাখতে পারেন।
-
কফি, চা, কোমল পানীয় ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলো শরীরকে আরও ডিহাইড্রেট করে।
২. হিট স্ট্রোক
হিট স্ট্রোক গ্রীষ্মকালীন সবচেয়ে বিপজ্জনক স্বাস্থ্য সমস্যা। যখন শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়ে শরীরের স্বাভাবিক কুলিং সিস্টেম ব্যর্থ হয়, তখন ঘটে হিট স্ট্রোক। এটি একটি মেডিকেল এমার্জেন্সি হিসেবে বিবেচিত।
লক্ষণ:
-
শরীরের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি
-
মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি, বা বেহুঁশ হয়ে যাওয়া
-
ত্বক শুকিয়ে যাওয়া, ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়া
-
শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হওয়া
-
বমি বমি ভাব, মাথাব্যথা
করণীয়:
-
দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চড়া রোদে বাইরে যাওয়া এড়িয়ে চলুন।
-
হালকা রঙের, ঢিলেঢালা এবং সুতির কাপড় পড়ুন।
-
বাইরে বের হলে ছাতা, সানগ্লাস ও টুপি ব্যবহার করুন।
-
শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য ওয়েট টাওয়েল ব্যবহার করুন, প্রয়োজন হলে পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছুন।
-
হিট স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ঠান্ডা পরিবেশে নিয়ে যান এবং পানি বা স্যালাইন দিন।
৩. খাদ্যে বিষক্রিয়া (ফুড পয়জনিং)
উচ্চ তাপমাত্রার কারণে খাবার দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে সংরক্ষণ কিংবা রান্নার পরে দীর্ঘক্ষণ রেখে দিলে সেগুলিতে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়, যা খাদ্যে বিষক্রিয়ার অন্যতম কারণ।
লক্ষণ:
-
পেট ব্যথা
-
বমি
-
ডায়রিয়া
-
মাথাব্যথা
-
জ্বর
করণীয়:
-
বাসি ও দীর্ঘক্ষণ ফেলে রাখা খাবার না খাওয়াই ভালো।
-
রাস্তার খোলা খাবার, শরবত, আখের রস এসব এড়িয়ে চলুন।
-
খাদ্য পচন ঠেকাতে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন।
-
রান্নার আগে ও পরে হাত ভালো করে ধুয়ে নিন।
-
ফলমূল ও শাকসবজি ভালো করে ধুয়ে খান।
৪. ত্বকের সমস্যা: ঘামাচি ও ফুসকুড়ি
গ্রীষ্মের অন্যতম বিরক্তিকর সমস্যা হলো ঘামাচি ও অন্যান্য চর্মরোগ। অতিরিক্ত ঘাম জমে ত্বকের ছিদ্রে আটকে গিয়ে ফুসকুড়ির মতো দানা তৈরি করে। এসব স্থান চুলকায় এবং ঘষা লাগলে সংক্রমণ হতে পারে।
লক্ষণ:
-
লালচে ছোট দানা
-
চুলকানি
-
ত্বক জ্বালাপোড়া
করণীয়:
-
সুতির আরামদায়ক কাপড় পরুন।
-
নিয়মিত দিনে অন্তত দুইবার গোসল করুন।
-
বাইরে বের হওয়ার আগে ত্বকে এসপিএফ ৫০ সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
-
ঘামাচির জায়গায় অ্যান্টিসেপটিক পাউডার ব্যবহার করতে পারেন।
-
বেশি সমস্যা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৫. অ্যালার্জি ও সংক্রমণ
ধুলাবালি, ঘাম, ঘরের আর্দ্রতা ও গরম পরিবেশে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা অ্যালার্জি এবং সংক্রমণের কারণ হয়। চোখে সংক্রমণ, ত্বকে র্যাশ ও নাক-কানে অ্যালার্জি হতে দেখা যায়।
লক্ষণ:
-
চোখ লাল হওয়া, চুলকানো
-
নাক দিয়ে পানি পড়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া
-
ত্বকে ফুসকুড়ি
-
সর্দি-কাশি
করণীয়:
-
আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখুন।
-
ঘরের ধুলাবালি পরিষ্কার রাখুন, বিশেষ করে বিছানাপত্র ও পর্দা নিয়মিত ধুয়ে নিন।
-
বাইরে গেলে সানগ্লাস ও মাস্ক ব্যবহার করুন।
-
বারবার চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
-
হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন, বিশেষ করে খাবার খাওয়ার আগে ও পরে।
গ্রীষ্মের তীব্র তাপমাত্রা শুধু অস্বস্তিকরই নয়, সময়মতো সতর্ক না হলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই গরমকালীন এসব রোগ ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং আগেভাগে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে হাইড্রেটেড থাকা, নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ও রোদ থেকে নিজেকে রক্ষা করলেই অনেকাংশে এই সময়টাকে সুস্থভাবে কাটানো সম্ভব।
এই গ্রীষ্মে সুস্থ থাকতে নিজেও সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন করুন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ