
ছবি: সংগৃহীত
গেঁটে বাত বা গাউট বর্তমানে এক পরিচিত, অথচ যন্ত্রণাদায়ক স্বাস্থ্যসমস্যা, যা একবার শুরু হলে দীর্ঘদিন ভোগাতে পারে। হঠাৎ করে কোনও এক সন্ধ্যায় পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে শুরু হওয়া তীব্র ব্যথা, লালচে রঙ ধারণ এবং ফোলাভাব—এসবই গেঁটে বাতের প্রাথমিক লক্ষণ। তবে এই সমস্যা শুধু পায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। শরীরের যেকোনো জয়েন্টে ছড়িয়ে যেতে পারে এই প্রদাহজনিত বাত।
ইউরিক অ্যাসিডই মূল অপরাধী
গেঁটে বাতের পেছনে মূল কারণ হলো রক্তে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড জমা হওয়া। সাধারণত শরীরের কোষে থাকা পিউরিন নামক একটি প্রাকৃতিক উপাদান ভাঙার ফলে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। স্বাভাবিক অবস্থায় এটি কিডনির মাধ্যমে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কিডনি যদি ঠিকমতো কাজ না করে বা খাদ্যাভ্যাসে অতিরিক্ত পিউরিনজাত খাবার থাকে, তবে শরীরে ইউরিক অ্যাসিড জমে যায় এবং তা জয়েন্টে স্ফটিক আকারে জমতে শুরু করে। এর ফলে সৃষ্টি হয় তীব্র ব্যথা ও প্রদাহ।
এটি শুধু অস্থিসন্ধির ব্যথা বাড়ায় না, বরং দীর্ঘমেয়াদে কিডনি জটিলতা এবং হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই শুরুতেই সচেতন হওয়া প্রয়োজন, এবং সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধক হলো খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রার সঠিক পরিকল্পনা।
কোন খাবারগুলো উপকারী?
ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফলমূল
গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করলে রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। আমলকি, পেয়ারা, লেবু, কমলা, কিউই, ক্যাপসিকাম, স্ট্রবেরি, পেঁপে— এসব ফল ভিটামিন সি সমৃদ্ধ এবং প্রতিদিনকার খাদ্যতালিকায় রাখলে গেঁটে বাতের প্রকোপ হ্রাস পায়।
আনারস ও আপেল
আনারসে থাকা ব্রোমেলিন নামক একটি এনজাইম প্রদাহ এবং ব্যথা কমাতে কার্যকর। অপরদিকে, আপেলে থাকা মেলিক অ্যাসিড এবং অ্যাপেল সিডার ভিনেগারে থাকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড লিভার পরিষ্কারে সহায়ক, এবং শরীরের অ্যালকালাইন ব্যালান্স বজায় রাখতে সাহায্য করে।
লো-ফ্যাট প্রোটিন
ডিমের সাদা অংশ, লো-ফ্যাট দুধ ও দই, ছানা, কাঠবাদাম এবং দেশি নদীর মাছ—যেমন রুই, কাতল, পাবদা ইত্যাদি তুলনামূলকভাবে কম পিউরিনযুক্ত। এগুলো উচ্চমানের প্রোটিন সরবরাহ করলেও ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির ঝুঁকি থাকে না।
আঁশযুক্ত সবজি ও কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট
প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০০ গ্রাম শাকসবজি, আঁশসমৃদ্ধ সালাদ ও লাল চাল, লাল আটার রুটি, ওটস, মিষ্টি আলুর মতো খাবার গ্রহণ করলে অন্ত্রে ইউরিক অ্যাসিডের শোষণ কমে যায়, যা শরীর থেকে বর্জ্য অপসারণ সহজ করে তোলে।
পর্যাপ্ত পানি ও হাইড্রেশন
ইউরিক অ্যাসিড অপসারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পর্যাপ্ত পানি পান করা। দিনে অন্তত ১২ গ্লাস পানি কিডনিকে সচল রাখে এবং ইউরিক অ্যাসিড নিঃসরণ বাড়ায়। সাথে গ্রিন-টি, লেবু পানি, আদা পানি ও ডাবের পানিও খাওয়া যেতে পারে।
স্বাস্থ্যকর চর্বি ও মসলা
ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ অলিভ অয়েল, সরিষার তেল, কাঠবাদাম প্রদাহ কমায়। আদা, রসুন, হলুদ ও গোলমরিচের মতো প্রাকৃতিক উপাদান প্রদাহবিরোধী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা ব্যথা ও ফোলাভাব হ্রাসে সহায়ক।
কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত?
লাল মাংস, যেমন গরু বা খাসির মাংস।
প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন কলিজা, ভুঁড়ি, পায়া।
সামুদ্রিক মাছ—বিশেষ করে ইলিশ, চিংড়ি, শুঁটকি।
পিউরিন সমৃদ্ধ ডাল ও শাক—যেমন ছোলা, রাজমা, পুই, পালং শাক, মটরশুঁটি, মাশরুম।
ফ্রুকটোজ ও ইস্টযুক্ত খাবার—পাউরুটি, কেক, কোমল পানীয়, চকলেট, চিনি-গুড় ও মিষ্টান্ন।
প্রসেসড ফুড, ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত ফাস্ট ফুড, ইনস্ট্যান্ট রেডি-মিল।
এই খাবারগুলো শরীরে পিউরিনের মাত্রা বাড়িয়ে ইউরিক অ্যাসিডের উৎপাদন বাড়ায়, ফলে গেঁটে বাতের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
সীমিত পরিমাণে গ্রহণযোগ্য খাবার
সাদা চালের ভাত, কলা, আম, কাঁঠাল, নুডলস, পাস্তা—এগুলো উচ্চ গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত। মাঝে মাঝে সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা যেতে পারে তবে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকলে তা ক্ষতিকর হতে পারে।
জীবনযাপনে পরিবর্তন এনে গেঁটে বাত নিয়ন্ত্রণ
খাবারের পাশাপাশি জীবনযাপনের ধরনও ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। এজন্য নিচের বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি—
প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট রোদে থাকুন—ভিটামিন ডি ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত গভীর ঘুম নিশ্চিত করুন—ঘুমের অভাব ইউরিক অ্যাসিডের বিপাকে প্রভাব ফেলে।
নিয়মিত হালকা ব্যায়াম ও হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন—অতিরিক্ত ওজন গেঁটে বাতের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ কারণ।
গেঁটে বাত বা গাউট চিকিৎসাযোগ্য একটি রোগ। তবে একে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে শুধুমাত্র ওষুধে ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না। বরং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত পানি পান, ঘুমের যথাযথতা এবং ধূমপান ও মদ্যপানের মতো অভ্যাস বর্জনই হলো এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান। যে কেউ যদি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করে, তবে এই রোগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সবচেয়ে ভালো ফল পেতে পুষ্টিবিদের পরামর্শমতো খাদ্য তালিকা অনুসরণ করা উচিত। গেঁটে বাত থেকে মুক্তি চাইলে পরিবর্তন আনুন প্রতিদিনের প্লেটে এবং আপনার জীবনযাপনে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ