
ছবি: সংগৃহীত
টি-ব্যাগে চা পানের অভ্যাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত চা বানানোর সুবিধা এবং সহজলভ্যতার কারণে বিশেষ করে অফিস, বাসা বা বন্ধুদের আড্ডায় এটি বেশ জনপ্রিয়। তবে একটি নতুন গবেষণা এই প্রথাকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যা আমাদের জন্য এক বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে, বাণিজ্যিক টি-ব্যাগ থেকে মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণার প্রবাহ মানুষের শরীরে ঢুকে যেতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষণার বিস্তারিত
২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ‘কেমোস্ফিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বার্সেলোনার অটোনোমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, বাণিজ্যিক টি-ব্যাগ থেকে চা তৈরির সময় বিপুল পরিমাণ মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা মানুষের শরীরে প্রবাহিত হতে পারে। এই গবেষণাটি বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করেছে, কারণ এতে এটি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পলিমার বা প্লাস্টিক উপাদানে তৈরি টি-ব্যাগ থেকে চায়ের পানিতে প্রায় লাখ লাখ ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রবাহিত হয়।
গবেষণায় ব্যবহৃত টি-ব্যাগগুলি বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্র্যান্ড থেকে সংগ্রহ করা হলেও, এই ব্র্যান্ডগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়নি। তবে গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ব্যাগগুলি সাধারণত নাইলন-৬, পলিপ্রোপিলিন এবং সেলুলোজের মতো প্লাস্টিক উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। এসব উপাদান থেকে চা তৈরির সময় বিপুল সংখ্যক মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা নির্গত হয়।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বিভিন্ন উপাদান থেকে নির্গত প্লাস্টিক কণার পরিমাণ এমন ছিল:
পলিপ্রোপিলিন: প্রতি মিলিলিটার চায়ের পানিতে ১.২ বিলিয়ন প্লাস্টিক কণা ত্যাগ করে।
সেলুলোজ: ১৩৫ মিলিয়ন প্লাস্টিক কণা ত্যাগ করে।
নাইলন-৬: ৮.১৮ মিলিয়ন প্লাস্টিক কণা ত্যাগ করে।
এই ক্ষুদ্র কণাগুলো মানব অন্ত্রের কোষ দ্বারা শোষিত হয়ে রক্তপ্রবাহে প্রবাহিত হতে পারে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
কীভাবে ক্ষতি হয়?
গবেষকরা আরও জানান, এই প্লাস্টিক কণাগুলো মানুষের অন্ত্রের মিউকাস উৎপাদনকারী কোষে প্রবেশ করতে পারে। এটি কোষের নিউক্লিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। নিউক্লিয়াস হল কোষের জেনেটিক উপাদান নিয়ন্ত্রণকারী অংশ, যার মাধ্যমে কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রিত হয়। প্লাস্টিক কণাগুলোর এই ধরনের প্রবাহ কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে এবং সেগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষক আলবা গার্সিয়া-রদ্রিগেজ বলেন, "আমরা নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে দূষণ কণাগুলোর উপস্থিতি শনাক্ত করেছি, যা মানব দেহে এই কণাগুলোর প্রভাবকে আরও বিস্তারিতভাবে বোঝার সুযোগ তৈরি করেছে। এটি ভবিষ্যতে নতুন গবেষণার ভিত্তি তৈরি করবে।"
বাংলাদেশে প্রভাব
বাংলাদেশে বাণিজ্যিক টি-ব্যাগের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে, কারণ সাধারণ চা বানানোর ঝামেলা এড়িয়ে সহজে চা পান করা যায়। বিশেষ করে অফিসের কর্মীরা বা ব্যস্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় টি-ব্যাগ ব্যবহার করেন। তবে এই গবেষণার তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বাজারে সহজলভ্য টি-ব্যাগগুলোতেও এই ধরনের প্লাস্টিক উপাদান থাকতে পারে, যা মানব শরীরের জন্য বিপজ্জনক।
সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি
গবেষণায় বলা হয়েছে, মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণার কারণে শরীরের বেশ কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:
কোষের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি: প্লাস্টিক কণাগুলোর কারণে কোষের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি: অন্ত্রের কোষে প্রবাহিত হওয়া প্লাস্টিক কণাগুলো পরিপাকতন্ত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে হজম প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে।
জেনেটিক উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া: প্লাস্টিক কণাগুলো কোষের নিউক্লিয়াসে প্রবাহিত হয়ে জেনেটিক উপাদানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যা মিউটেশনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
প্রদাহ: প্লাস্টিক কণাগুলোর কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, যা বিভিন্ন ধরনের রোগের কারণ হতে পারে।
ক্যানসারের ঝুঁকি: দীর্ঘমেয়াদী সংস্পর্শে থাকা প্লাস্টিক কণাগুলোর কারণে ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
কীভাবে ঝুঁকি এড়ানো যায়?
বিশেষজ্ঞরা কিছু সহজ পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন যা এই ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে:
পাতা চা ব্যবহার: টি-ব্যাগের পরিবর্তে পাতা চা ব্যবহার করা, যা স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ।
প্রাকৃতিক ছাঁকনি ব্যবহার: ধাতব বা কাপড়ের ছাঁকনি দিয়ে চা বানানো অনেক নিরাপদ হতে পারে।
টেকসই ব্র্যান্ড বাছাই: পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে তৈরি টি-ব্যাগ ব্যবহার করা, যা মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক নির্গত হওয়ার সম্ভাবনা কমায়।
ভবিষ্যত গবেষণা এবং নীতিমালা
গবেষকরা এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের মতে, মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিকের মানব শরীরে প্রভাব নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন রয়েছে, যা ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও নিরাপদ চা প্রস্তুতির জন্য নীতিমালা তৈরি করতে সাহায্য করবে। চা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, তবে এর নিরাপদ উপভোগ নিশ্চিত করতে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
এই গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে, জনগণ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সচেতন করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ পদ্ধতিতে চা পান করতে পারে এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন না হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ