
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে যৌনস্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরেই নানা উদ্যোগ চলছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উভয়ের ক্ষেত্রেই যৌনবাহিত রোগ বা সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজেস (এসটিডি) ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে যখন এই রোগগুলোর সংক্রমণ গোড়ার দিকে নিরব থাকে বা সামান্য উপসর্গ প্রকাশ করে, তখন এগুলো আরও মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে এবং শেষমেষ বন্ধ্যাত্বের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গনোরিয়া, সিফিলিসের মতো যৌনরোগগুলো শুরুর দিকে প্রায় লক্ষণহীন থাকে, যার ফলে অনেক সময় রোগীরা বুঝতেই পারেন না যে তাদের শরীরে সংক্রমণ হয়েছে। গনোরিয়ার ক্ষেত্রে, মেয়েদের মাঝে ঋতুচক্রের অনিয়ম, মাঝেমধ্যে রক্তপাত (স্পটিং), প্রস্রাবে জ্বালাভাব, এমনকি অবহেলিত অবস্থায় রোগটি জরায়ু ও ফ্যালোপিয়ান টিউবে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি করে। এতে করে টিউবাল প্রেগন্যান্সি এবং সন্তান ধারণের জটিলতাও দেখা দিতে পারে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও রোগটি প্রস্রাবে জ্বালাভাব এবং পরবর্তীকালে শুক্রাণু উৎপাদনে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে, যৌনরোগ নির্মূলের এক যুগান্তকারী সম্ভাবনার কথা জানালেন বিজ্ঞানীরা। ব্রিটেনের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সির গবেষকরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, যৌনবাহিত রোগ গনোরিয়া নির্মূলে একটি নতুন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হয়েছে, যার নাম জেপোটিডাসিন।
মূলত, এই ওষুধটি আগে মূত্রনালির সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের (UTI) চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। তবে বিজ্ঞানীরা ওষুধটির গঠন এবং রাসায়নিক উপাদানে বিশেষ পরিবর্তন এনে এখন যৌনরোগের চিকিৎসায়ও ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করেছেন।
বিখ্যাত চিকিৎসা সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে ইঁদুরের ওপর প্রাথমিক পরীক্ষায় অত্যন্ত ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া গেছে। এরপর মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো হয়, যেখানে ৬২৮ জন গনোরিয়া আক্রান্ত নারী-পুরুষের ওপর ওষুধটি প্রয়োগ করা হয়।
গবেষণাপ্রধান ডা. কেটি সিঙ্কা জানিয়েছেন, কয়েক মাসব্যাপী পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের ফলে ৯৩ শতাংশ আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। শুধু তাই নয়, ওষুধটি শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণাপত্রে।
গনোরিয়ার জীবাণু নিসেরিয়া গনোরি (Neisseria gonorrhoeae) দিনে দিনে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে বলে যে আশঙ্কা ছিল, তা রোধ করতে জেপোটিডাসিন বিশেষ কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন গবেষকরা। বর্তমানে গনোরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রেই প্রত্যাশিত কাজ করছে না। ফলে নতুন ওষুধের আগমন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের আশান্বিত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সময়মতো চিকিৎসা না করলে গনোরিয়ার মতো যৌনরোগ জীবনের জন্য ভয়াবহ দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা ডেকে আনতে পারে। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই ওষুধটির সহজলভ্যতা যৌনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনবে বলেও মত দিয়েছেন গবেষকরা।
ডা. কেটি সিঙ্কা আরও জানান, বর্তমানে ওষুধটির শেষ ধাপের পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষায় যদি ইতিবাচক ফলাফল অব্যাহত থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই এটি বাজারে ছাড়া হবে। তখন চিকিৎসকরা গনোরিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য যৌনবাহিত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণেও এটি ব্যবহার করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা আরও সতর্ক করে বলেন, ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা বাড়ানোও জরুরি। অসুরক্ষিত যৌনসম্পর্ক পরিহার, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত শিক্ষার প্রসার এবং রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি।
সার্বিকভাবে নতুন ওষুধ জেপোটিডাসিন যৌনরোগ নির্মূলের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এক বড় মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ