
ছবি: সংগৃহীত
দূর থেকে কিছু দেখতে অসুবিধা হচ্ছে, লেখাপড়ায় সমস্যা হচ্ছে, ক্লাসরুমের ব্ল্যাকবোর্ডের লেখা ঝাপসা লাগছে—এমন সমস্যায় ভুগছে আজকের অনেক শিশু। এতদিন পর্যন্ত এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলেই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চোখ পরীক্ষা করিয়ে চশমা নেওয়াই ছিল একমাত্র সমাধান। তবে এবার এই দীর্ঘপ্রচলিত পদ্ধতির বাইরে নতুন এক দিগন্ত খুলতে চলেছে।
দেশের বাজারে খুব শিগগিরই আসছে একটি নতুন আই ড্রপ, যা মায়োপিয়া বা নিকটদৃষ্টি সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আই ড্রপটি উৎপাদন করেছে এনটড ফার্মাসিউটিক্যালস নামের একটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটির দাবি, নতুন ফর্মুলায় তৈরি এই আই ড্রপ শিশুদের দৃষ্টিশক্তির সমস্যা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এবং দীর্ঘমেয়াদে চশমার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনবে।
মোবাইল-ট্যাব-টিভির যুগে শিশুদের বাড়ছে দৃষ্টিসংক্রান্ত সমস্যা
বর্তমান প্রজন্মের শিশুরা মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট ও টিভির পর্দায় অতিরিক্ত সময় ব্যয় করছে। পাশাপাশি কম আলোতে মোবাইল স্ক্রল করার মতো অভ্যাসও ক্রমেই দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করছে। শহরাঞ্চলের শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ফলে চোখে চাপ, ব্যথা, লালচে ভাব, পানিপড়া, এমনকি মাইগ্রেনের মতো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব সমস্যা শুধু চোখের ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভবিষ্যতে পড়াশোনা, ক্যারিয়ার এমনকি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
কীভাবে কাজ করবে নতুন আই ড্রপ
এনটড ফার্মাসিউটিক্যালস জানিয়েছে, নতুন এই আই ড্রপ মায়োপিয়ার ঝুঁকি কমাতে কাজ করবে। যেসব শিশু দূরের বস্তু দেখতে সমস্যায় পড়ছে, স্কুলের বোর্ডের লেখা ঝাপসা দেখছে বা চোখে অস্বস্তি অনুভব করছে, তাদের জন্য এই আই ড্রপ কার্যকর হতে পারে।
তবে চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলেছেন, মায়োপিয়া নির্ণয়ের পর অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে এই ড্রপ ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকের অনুমোদন ছাড়া আই ড্রপ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। কেন্দ্রীয় ড্রাগ নিয়ামক সংস্থা ইতোমধ্যে আই ড্রপটির ব্যবহারে ছাড়পত্র দিয়েছে, যা শিগগিরই দেশের বাজারে পাওয়া যাবে।
এনটড ফার্মাসিউটিক্যালস আরও জানিয়েছে, ৬ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য বিশেষভাবে এই আই ড্রপ তৈরি করা হয়েছে। তিন পর্যায়ে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন করার পর ওষুধটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আশার কথা, এখন পর্যন্ত কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
দৃষ্টিশক্তির বিপদ: ভবিষ্যতে মায়োপিয়া মহামারী?
কিছুদিন আগে ‘দ্য ল্যানসেট’ মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হবে। বিশেষ করে শিশু-কিশোররাই এই সমস্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে।
গবেষকেরা দেখিয়েছেন, আধুনিক জীবনধারায় শিশুদের প্রকৃতির আলো থেকে দূরে থাকা এবং কৃত্রিম আলোয় বেশি সময় ব্যয় করা একটি বড় কারণ। প্রাকৃতিক সূর্যালোকে বেশি সময় কাটালে রেটিনায় ডোপামিন নামক গুরুত্বপূর্ণ যৌগের ক্ষরণ বাড়ে, যা চোখের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং মায়োপিয়ার ঝুঁকি কমায়।
কিন্তু টানা অন্ধকার ঘরে বা কৃত্রিম আলোয় মোবাইল, ট্যাবলেট ব্যবহারের ফলে চোখের উপর মারাত্মক চাপ পড়ে। নীল রশ্মি বা ব্লু-লাইটের অতিরিক্ত এক্সপোজার রেটিনার ক্ষতি করে এবং সময়ের সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে শুধু চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া নয়, চোখে ব্যথা, লাল হওয়া, মাথাব্যথা এবং দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা তৈরি হয়।
শুধু আই ড্রপ নয়, অভ্যাসেও দরকার পরিবর্তন
চিকিৎসক ও গবেষকেরা বলছেন, শুধু আই ড্রপ ব্যবহারে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি প্রয়োজন শিশুদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন—
দিনে অন্তত ১-২ ঘণ্টা খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক আলোতে সময় কাটাতে হবে।
টানা স্ক্রিন দেখার সময় ২০ মিনিট পরপর অন্তত ২০ সেকেন্ড দূরে তাকিয়ে বিশ্রাম দিতে হবে (২০-২০ নিয়ম)।
মোবাইল, ট্যাব এবং টিভি ব্যবহারে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
রাতে মোবাইল বা ট্যাব কম আলোতে ব্যবহার না করাই ভালো।
শিশুদের দৈনন্দিন ব্যায়াম এবং খেলাধুলার সময় বাড়াতে হবে।
নতুন এই আই ড্রপ নিঃসন্দেহে মায়োপিয়ার মতো এক উদ্বেগজনক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আশার আলো জ্বালাবে। তবে চোখের সুস্থতা রক্ষায় সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার উন্নতি ও সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য।
শিশুদের চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখনই প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপ—আই ড্রপের পাশাপাশি প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার ও প্রকৃতির সংস্পর্শে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দৃষ্টিশক্তি নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ