
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের বহু দেশে নবজাতকের পায়ের গোড়ালির রক্ত পরীক্ষা করে তার ভবিষ্যতে সম্ভাব্য রোগ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি সম্পর্কে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। এটি শুধু সঠিক সময়মতো চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সহায়ক নয়, বরং ভবিষ্যতে নবজাতকের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। বাংলাদেশে যদি এই প্রক্রিয়া চালু করা যায়, তবে হাজারো নবজাতককে বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত রাখা সম্ভব হবে, বিশেষজ্ঞদের এমন মন্তব্য।
এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বাংলাদেশের চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে (বিসিএফসিসি) অনুষ্ঠিত ‘সপ্তম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। এতে উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় শিশু চিকিৎসকরা। অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে তারা বলেন, নবজাতকের পায়ের গোড়ালির রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি আগে থেকেই চিহ্নিত করা সম্ভব এবং সে অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
‘বাংলাদেশ নিওনেটাল ফোরাম’ (বিএনএফ) কর্তৃক আয়োজিত এই সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবজাতক চিকিৎসার আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে নবজাতক স্বাস্থ্য ঝুঁকির আগে থেকেই ধারণা পাওয়া সম্ভব। চিকিৎসকরা আরো বলেন, যদি শিশুর ভেতরে কোনো বিপদজনক রোগ বা শারীরিক সমস্যা থাকে, তবে সে অনুযায়ী শুরুর দিকে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, যা শিশুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী সুফল বয়ে আনবে। এটি শুধু নবজাতকের স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট নয়, পরিবার এবং জাতির জন্যও আর্থিক সাশ্রয়ী হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নবজাতক যে স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ঝুঁকিতে থাকতে পারে, তা আগেই চিহ্নিত করা সম্ভব। এগুলোর মধ্যে হতে পারে গ্লুকোজের পরিমাণ, হরমোনের ভারসাম্য বা বিশেষ ধরনের জন্মগত রোগ। এই পরীক্ষার মাধ্যমে আগামী দিনের রোগের পূর্বাভাস পাওয়ার ফলে চিকিৎসকরা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়ার আগেই সঠিক চিকিৎসা শুরুর জন্য প্রস্তুত থাকতে পারবেন। এতে সময়ের সাশ্রয় হবে এবং একদিকে যেমন শিশুদের জীবন রক্ষা হবে, অন্যদিকে পরিবারগুলোকেও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা খরচ থেকে মুক্ত রাখা যাবে।
এই পরীক্ষা প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি শুধুমাত্র রোগের সঠিক সময়ে চিকিৎসার সুযোগ দেয়, কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। নবজাতকের শারীরিক পরীক্ষা এবং যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সম্ভাবনা কমানো যায়।
বাংলাদেশে নবজাতক স্বাস্থ্য বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে একটি পলিসি সেশনও অনুষ্ঠিত হয়। সেশনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ‘নবজাতকের পায়ের গোড়ালির রক্ত পরীক্ষা করে ভবিষ্যৎ রোগ নির্ধারণে বাংলাদেশের অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’। এটি ছিল দেশের নবজাতক চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের চিন্তাভাবনা এবং ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা তুলে ধরার একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।
এছাড়া, সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, নবজাতক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ও জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে ভবিষ্যতে এসব স্বাস্থ্য ঝুঁকি প্রতিরোধ করতে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে শীর্ষস্থানীয় হতে পারে। বিশেষত, শিশুদের চিকিৎসায় একাডেমিক উন্নয়ন এবং আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তির ব্যবহার আগামী প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘সপ্তম আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন’-এ বক্তৃতা দিয়ে ইউনিসেফের ডেপুটি বাংলাদেশ প্রতিনিধি এমা ব্রিগ্রাম এবং বিএনএফ এর সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. সুখময় কংস বণিক নবজাতক স্বাস্থ্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন। তাদের বক্তব্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সরকার এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে নবজাতক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রচেষ্টা আরো জোরদার করা হবে। এর মাধ্যমে সকল দেশের জন্য একটি উৎকৃষ্ট মডেল হিসেবে দাঁড়ানো সম্ভব হবে।
এছাড়া, ভবিষ্যতে দেশের স্বাস্থ্য খাতে আরও উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত আধুনিকায়ন এবং বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ নিয়ে অধিক কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে। এতে নবজাতকদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করণসহ সবার জন্য সাশ্রয়ী ও বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।
এবারের সম্মেলনটি দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং এতে ৭২১ জন নবজাতক বিশেষজ্ঞসহ চারজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ উপস্থিত ছিলেন। তারা বিভিন্ন বিজ্ঞানী প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন, যা নবজাতক চিকিৎসা সেবা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তুলে ধরে। সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন নতুন পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন নবজাতক চিকিৎসার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে এবং দেশের স্বাস্থ্য সেবার উন্নতির জন্য অবদান রাখবে।
নবজাতকের পায়ের গোড়ালির রক্ত পরীক্ষা করে ভবিষ্যৎ রোগ নির্ধারণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নবজাতক স্বাস্থ্য খাতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এই পরীক্ষা প্রক্রিয়া চালু হলে একদিকে যেমন নবজাতকের সুস্থতা নিশ্চিত করা যাবে, অন্যদিকে পরিবারের জন্যও এটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। একইসাথে, এটি দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ